সাদ্দাম, নেতানিয়াহু ও ইরানিদের সর্বশেষ কৌশল; সাময়িক বিজয় থেকে কৌশলগত পরাজয়
পার্সটুডে- ইহুদিবাদী ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পরিণতি ইরাকের সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দামের মতো হবে বলে মনে করেন একজন ইরানি রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
পার্সটুডের রিপোর্ট অনুযায়ী, ইরানের সাবেক সংস্কৃতি ও ইসলামি দিকনির্দেশনা-মন্ত্রী সাইয়্যেদ আতাউল্লাহ মোহাজেরানি গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ইহুদিবাদী ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ইরাকের সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দামের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
তিনি লিখেছেন: ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে যখন ইরাকের সেনাবাহিনী কুয়েত দখল করে তখন ইরাকের দ্বিতীয় শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর তৎকালীন উপ প্রধান ইজ্জাত ইব্রাহিম আদ-দুরি (১৯৪২-২০২০) দেশটির তৎকালীন উপ প্রধানমন্ত্রী সাদুন হাম্মাদিকে (১৯৩০-২০০৭) নিয়ে ইরান সফরে আসেন। ইজ্জাত ইব্রাহিমকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাশেমি রাফজানজানির ভাইস প্রেসিডেন্ট হাসান হাবিবি এবং সাদুন হাম্মাদিকে স্বাগত জানাতে গিয়েছিলাম আমি। ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী উভয়ের দায়িত্বে ছিলেন সাদ্দাম। কথা হয়, ইরাকি প্রতিনিধিদল জিয়ারতের উদ্দেশ্যে ইরানের পূর্বাঞ্চলীয় মাশহাদ শহরে যাবে। হোস্ট হিসেবে আমি তাদের সফরসঙ্গী ছিলাম। ওই সফরের ঘটনাবলী আমি ‘শান্তিপিপাসু’ বইতে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছি। আমি যে কারণে সাদ্দাম ও নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যক্তিত্বকে একইরকম মনে করছি, সেটি আমি ওই সফরের সময় অফ দ্যা রেকর্ডে সাদুন হাম্মাদির কানে কানে বলেছিলাম। কিন্তু আমি একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারা পরিবর্তন হয়ে যায় এবং তিনি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। আমি তাকে বলেছিলাম: “সাদ্দাম সাময়িক সাফল্যের দিক দিয়ে অসাধারণ কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের দিক দিয়ে উন্মাদ। যখন ইরানে ইমাম খোমেনীর (রহ.) মতো নেতা বিদ্যমান এবং এদেশে সদ্য বিপ্লব হয়েছে তখন আমেরিকা ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও ইরানের ওপর হামলা ছিল কৌশলগত উন্মাদনা।”
ফলাফল আমাদের সামনে স্পষ্ট! নেতানিয়াহু ইসরাইলি পণবন্দিদের মুক্ত করার পরিবর্তে ফিলিস্তিনিদের ওপর জাতিগত শুদ্ধি অভিযান ও গাজা উপত্যকাকে ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১৩ মাস ধরে তার এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন অসমাপ্ত রেখেই আবার লেবাননে আগ্রাসন চালিয়েছেন। হিজবুল্লাহ মহাসচিব শেখ নাঈম কাসেমের ভাষায়, নেতানিয়াহু ‘যুদ্ধ’কে ‘হত্যাকাণ্ডে’ পরিণত করেছেন। এটি হচ্ছে যুদ্ধের কৌশলকে সাময়িক বিজয়ে পরিণত করার এই কথা আমি আগেই বলেছি। এই পর্যায়ে এসে ইহুদিবাদী প্রধানমন্ত্রী সিরিয়া ও লেবাননে ইরানি সামরিক উপদেষ্টা ও সেনা কমান্ডারদের হত্যা করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। উন্মাদ শুধুমাত্র সেইসব অসহায় মানুষগুলো নয় যারা পাগলাগারদের নির্জন প্রকোষ্ঠে চুপচাপ বসে থাকেন।
ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোনাচিম বেগিন শেষ বয়সে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন এবং তাকে অধিকৃত ফিলিস্তিনের সেই দিরইয়াসিন গ্রামে নির্মিত পাগলাগারদে রাখা হয়েছিল যে গ্রামটিতে তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় গণহত্যা চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস, বেগিন যে গ্রামের মানুষের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিলেন সেই গ্রামে তাকে অসহায়ভাবে মরতে হয়েছে।
নেতানিয়াহু একজন কৌশলগত উন্মাদ কারণ তিনি এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ৪৩ হাজারের বেশি এবং লেবাননের অন্তত তিন হাজার মানুষকে হত্যা করেছেন। এমনকি তিনি ইরানের অতিথি থাকা অবস্থায় হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে তেহরানে হত্যা করেছেন। কৌশলগত উন্মাদরা সাময়িক বিজয়ের খুশিতে আত্মহারা থাকে। ইসরাইল ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করে। এরপর ইয়াহিয়া সিনওয়ার হামাসের নেতা হন। ইয়াহিয়া সিনওয়ার পরবর্তী এক বীরোচিত জিহাদি অভিযানে শাহাদাতবরণ করেন। এখনও হামাসের সামরিক শাখার কমান্ডার মোহাম্মাদ আদ-দেইফ বেঁচে আছেন এবং যুদ্ধ পরিচালনা করছেন।
ইহুদিবাদী ইসরাইল লেবাননের হিজবুল্লাহ নেতা সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহকে ৮২ হাজার কেজি বোমা নিক্ষেপ করে শহীদ করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও হিজবুল্লাহ বীরবিক্রমে টিকে আছে। হিজবুল্লাহর টিকে থাকার প্রমাণ এই সংগঠনের যোদ্ধাদের হাতে দক্ষিণ লেবাননে একশ’র বেশি ইসরাইলি সেনার নিহত হওয়া।
ইহুদিবাদী ইসরাইল ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে। এর প্রতিশোধ নিতে ইরান অপরেশন ট্রু প্রমিজ-১ ও ২ অভিযান পরিচালনা করেছে। আমার দৃষ্টিতে, ইসরাইলের মধ্যে যারা নেতানিয়াহুকে ইসরাইলের শত্রু ও এই অবৈধ রাষ্ট্রের ধ্বংসের কারণ মনে করে তারা সঠিক চিন্তা করছে!
সাদ্দাম ও তার কৌশলগত উন্মাদনা তার নিজের পাশাপাশি তার পরিবার, দল, ইরাকের সেনাবাহিনী ও খোদ ইরাককে ধ্বংস করেছে। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন যেমন সাদ্দামকে বাঁচাতে পারেনি তেমনি আমেরিকা ও ইউরোপ নেতানিয়াহুকে যে সর্বাত্মক সমর্থন দিচ্ছে নিয়েও সে তার লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। কেউ যদি ভুলপথে চলে তাহলে সে কোনোদিন গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। নেতানিয়াহুর বর্তমান পরিস্থিতি ইরানের জন্য শুভ বার্তা বহন করছে।#
পার্সটুডে/এমবিএ/জিএআর/১৭