ইরানের প্রতিরক্ষা ও পারমাণবিক নীতিতে পরিবর্তন আনার এখনই কি উপযুক্ত সুযোগ?
পার্সটুডে কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে সেখান থেকে পিছু না হঠার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউরোপ ও আমেরিকার আচরণ ও অবস্থান থেকে বোঝা যায় যে তারা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতি সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক নীতি গ্রহণ করেছে এবং একটি সংবাদ পত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে পার্সটুডে জানিয়েছে, ইরান বারবার জোর দিয়ে বলে আসছে যে তারা উত্তেজনা কমাতে চায় এবং শত্রুতার অবসান চায়। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো তেহরানের এই ইতিবাচক প্রচেষ্টার প্রতি সাড়া তো দেয়ই নি বরং তারা ইরানের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে তেহরানের ওপর চাপ এবং হুমকি অব্যাহত রেখেছে। বিগত বছরগুলোতে ইরান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ঘোষণা করেছে যে তার পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ না করার ব্যাপারে তেহরান যে নীতি গ্রহণ করেছে তা থেকে কোনো বিচ্যুতি ঘটে নি। এছাড়া, ইসলামিক প্রজাতন্ত্র বারবার ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর পশ্চিমা দাবি প্রত্যাখ্যান করে ইউক্রেন যুদ্ধ বিষয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করা সত্ত্বেও পশ্চিমা দেশগুলো চাপ এবং হুমকির ভাষা ব্যবহার করে করে আসছে। তারা ইরানের সহযোগিতার অপব্যবহার করছে এবং সংলাপের পরিবেশ তৈরি করার পরিবর্তে তারা উত্তেজনা তৈরি করছে।
ইরান বিরোধী প্রস্তাব পাস করতে ৩ ইউরোপীয় দেশের প্রচেষ্টা
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার বোর্ড অফ গভর্নরসের বৈঠক যেখানে পরমাণু কর্মসূচি এবং সংস্থাটির সঙ্গে ইরানের সহযোগিতার মাত্রা পর্যালোচনা করার কথা রয়েছে সেটি গতকাল ভিয়েনায় শুরু হয়েছে। ইউরোপের ৩টি দেশ ইংল্যান্ড, জার্মানি এবং ফ্রান্স ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করেছে। প্রস্তাবে ইরানের ওপর চাপ বাড়াতে ইউরোপীয়দের কঠোর সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার মহাসচিবের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ ইসলামি স্পষ্টভাবে সতর্ক করেছেন যে ইরান এই প্রস্তাবের মুখে চুপ করে থাকবে না। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে যদি ইউরোপীয় দেশগুলো সংঘর্ষের পথ বেছে নেয় এবং ইরানের বিরুদ্ধে কোনো হস্তক্ষেপমূলক এবং ধ্বংসাত্মক প্রস্তাব জারি করা হয তাহলে আমরা অবিলম্বে সমানুপাতিক পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
পশ্চিমারা প্রতিনিয়ত তার দেয়া প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করেছে
বিগত বছরগুলোতে জেসিপিওএ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার এবং ইউরোপের প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও ইরান যতটা সম্ভব তার প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তার সদিচ্ছা দেখানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তেহরানের এই ইতিবাচক পদক্ষেপের জবাব না দিয়ে পশ্চিমারা হুমকি ও নিষেধাজ্ঞার পথ বেছে নিয়েছে।
ইরানের দৃঢ় সিদ্ধান্তের প্রয়োজনীয়তা
এমতাবস্থায় ইরানকে এসব হুমকির বিরুদ্ধে দৃঢ় এবং শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে কিছু বিশ্লেষক মনে করেন। ইরানের স্ট্র্যাটেজিক কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশন্সের প্রধান কামাল খারাজি এর আগে এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলেন যে হুমকির যুগে ইরান তার প্রতিরক্ষা নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে। পশ্চিমাদের আচরণের জবাবে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা বাড়াতে পারে এবং আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা কমিয়ে দিতে পারে। খারাজি যেমন উল্লেখ করেছেন হুমকির সময় হল গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিবর্তনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সেরা সময়।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির কাজ নির্ধারণের একটি সুযোগ
কিছু বিশেষজ্ঞ এও মনে করেন যে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে সেখান থেকে পিছু না হঠার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ইরানি কর্মকর্তাদের আচরণ ও বিবৃতির মাধ্যমে এটা স্পষ্ট যে ইরান তার বিরুদ্ধে জারি করা যেকোনো হুমকি ও প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যথাযথ ও পাল্টা ব্যাবস্থা নিতে প্রস্তুত। যেমন আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা হ্রাস করা, এই সংস্থার পরিদর্শকদের ইরানের পরমাণু স্থাপনা পরিদর্শনের মাত্রা কমিয়ে আনা এবং এমনকি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বাড়ানো এসব ইরানের নেয়া অন্যতম পদক্ষেপ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি দেখায় যে যদিও ইরান এখনও আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছে কিন্তু পশ্চিমাদের সংঘাতমূলক আচরণ আলোচনার পরিবেশকে দুর্বল ক্রমশ করে দিচ্ছে এবং ইরানকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা; ইরানের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক আচরণের আরেকটি উদাহরণ
গত সোমবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন কাউন্সিল একটি বিবৃতিতে ঘোষণা করেছে যে ইউরোপীয় দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞামূলক ব্যবস্থার সুযোগ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার প্রতি ইরানের সামরিক সহায়তার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য এবং লোহিত সাগরে প্রতিরোধকামী সংগঠনগুলোকে সমর্থন করার অজুহাতে দেয়া এই সিদ্ধান্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে ইউরোপের বৈরী আচরণের আরেকটি উদাহরণ।
নতুন নিষেধাজ্ঞা এবং ইরানের প্রতিরক্ষা শিল্পকে লক্ষ্যবস্তু করা
এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ড্রোন, মিসাইল ও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য জাহাজ ও বন্দর ব্যবহারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের উন্নয়ন ও উৎপাদনে ব্যবহৃত উপাদান রপ্তানি, স্থানান্তর, সরবরাহ বা বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে।
এই সিদ্ধান্ত যেটি সরাসরি ইরানের প্রতিরক্ষা শিল্প এবং কৌশলগত সক্ষমতাকে টার্গেট করে নেয়া হয়েছে তা উন্নত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইরানের সক্ষমতাকে হ্রাস করার জন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রচেষ্টার প্রতি ইঙ্গিত করছে। তেহরানের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন এই সিদ্ধান্ত নেয় তখন ইউক্রেনের যুদ্ধে ইরানের সামরিক সহায়তার বিষয়ে তাদের দাবির পক্ষে কোনও দৃঢ় এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হাজির করতে পারে নি।
ইউরোপের অংশীদাররা যারা জেসিপিওএতে তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি এবং নিজেদেরকে কেবল প্রতীকী বিবৃতি জারি করার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে তারা এখন নিষেধাজ্ঞা সম্প্রসারণের মাধ্যমে ইরানকে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির বিকাশ থেকে বিরত রাখতে চাইছে। ইরান বারবার বলে আসছে যে এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা তেহরানের কৌশলগত পরিকল্পনাগুলোতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেনি এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র তার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বিকাশের কার্যক্রম সবসময় অব্যাহত রাখবে।#
পার্সটুডে/এমবিএ//২০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।