ইস্ফাহানের সঙ্গীতধারা: ইরানি সংস্কৃতির এক অমূল্য ভাণ্ডার
-
ইস্ফাহানের সঙ্গীতধারা: ইরানি সংস্কৃতির এক অমূল্য ভাণ্ডার
পার্সটুডে: ইরানের স্পন্দিত হৃদয় ইস্ফাহান মূলত ফিরোজা পাথর, নীল গম্বুজ আর সাফাভি আমলের অনন্য স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত। তবে তার ভেতরে লুকিয়ে রয়েছে সঙ্গীতের এক মহামূল্যবান ভাণ্ডার যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইরানের সঙ্গীতধারাকে নতুন রূপ দিয়েছে।
হাসান কাসাইয়ের আধ্যাত্মিক বাঁশি থেকে তাজ ইস্ফাহানির সোনালি কণ্ঠ পর্যন্ত, এই শহর সর্বদা ইরানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দিকপালদের জন্য একটি মঞ্চ হিসেবে কাজ করেছে।
পার্সটুডে জানিয়েছে, ২০১১ সালে ইস্ফাহানের ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতধারা ইরানের জাতীয় অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়, যা ইরানি সংস্কৃতির অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে তার মর্যাদা নিশ্চিত করে।
বা'য়াত-ই-ইস্ফাহান: ভালোবাসার সুর
এই ঐতিহ্যের মূল কেন্দ্রে রয়েছে 'বায়াত-ই-ইস্ফাহান' নামে পরিচিত এক আধ্যাত্মিক সুরধারা। এটি ইরানি সঙ্গীতে সবচেয়ে জনপ্রিয় সুরগুলোর একটি, যা মূলত প্রেমঘন ও আবেগপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের জন্য প্রসিদ্ধ। একে অনেকেই বলেন “হাসরতের সুর”—যেন মৃদু বিষণ্নতায় ভরা এক সঙ্গীতযাত্রা, যা আবেগের স্রোত থেকে কখনো বিচ্যুত হয় না।
বায়াত-ই-ইস্ফাহান এসেছে হোমায়ুন রাগধারা থেকে, যা ইরানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম প্রধান কাঠামো। অন্য ধারার মতো আবেগের উত্থান-পতন নয়, বরং ধারাবাহিক কোমলতা আর আবেগময় স্রোতে এটি প্রেমের গল্প শোনায়। এমনকি যারা প্রাচ্য সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত নন, তাঁরাও এই সুর চিনতে পারেন। এতে পাশ্চাত্যের মাইনর স্কেলের সাদৃশ্য থাকলেও ক্ষুদ্র সুরভেদের (মাইক্রোটোন) মাধ্যমে এটি পুরোপুরি ইরানি রূপ ধারণ করে। এর আবেগময় চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পায় ‘অশশাক’ নামের অংশে, যা নামের মতোই গভীর প্রেমের বার্তা বহন করে।
ইস্ফাহানের সঙ্গীতের আত্মা
ইস্ফাহানের সঙ্গীতের ভূমিকা শুধু প্রযুক্তিগত কাঠামোয় সীমাবদ্ধ নয়; বরং শহরের চিরন্তন সঙ্গীতপ্রেমের সঙ্গে যুক্ত। সাফাভি আমলে, যখন ইস্ফাহান ইরানের রাজধানী ছিল, তখন সঙ্গীত ছিল রাজদরবারের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং শাহজাদাদের সঙ্গীত শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল।
কিছু গবেষকের মতে, ইস্ফাহানের সঙ্গীত ঐতিহ্য সাফাভিদ আমলের আগেই, প্রাচীন ইরানের ভেতরেই গড়ে উঠেছিল। এ সঙ্গীতের স্থায়িত্বের মূল কারণ হলো শহরের আত্মার প্রতিফলন: প্রেমঘন, চিন্তাশীল ও স্মৃতিমাখা।
এখানে এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো 'মুনাসাব-খানি'—যেখানে গায়ক আর বাদক একসঙ্গে মিলিত হয়ে সূক্ষ্ম কথোপকথনের মতো পরিবেশনা তৈরি করেন। কণ্ঠসঙ্গীতে নান্দনিক অলঙ্করণ (তাহরির) কবিতার আবেগকে বাড়িয়ে তোলে এবং এ ধারার অন্যতম চিহ্ন হয়ে উঠেছে।
এই ধারা পার্শ্ববর্তী জাতিগোষ্ঠী যেমন কাশকাই, বুয়ের আহমাদি ও দেজফুলি জনগোষ্ঠীর সুরকেও আত্মস্থ করেছে, যা ইস্ফাহানকে বহুসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক করে তুলেছে।
সুরের রক্ষক
ইস্ফাহানের সঙ্গীত টিকে আছে সেই গুরুদের কল্যাণে, যাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম এ মৌখিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করেছেন। কাজার আমলে ইস্ফাহানি তাজিয়া-গায়করা এ ধারার বৈশিষ্ট্য তেহরানে নিয়ে যান এবং নতুন প্রজন্মের সঙ্গীতজ্ঞদের প্রভাবিত করেন।
সৈয়দ রাহিম ইস্ফাহানি, তাজ ইস্ফাহানি প্রমুখ তাঁদের কণ্ঠ ও শিক্ষার মাধ্যমে এ ধারাকে অমর করে রাখেন। সাইয়্যেদ আব্দুর রহিম ইস্ফাহানি তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও কোমল কণ্ঠে তাজ ইস্ফাহানি, আদিব খোয়ানসারি ও হাবিব শাতেরহাজির মতো প্রতিভাবান শিষ্য গড়ে তোলেন।
ভায়োলিন ও সানতুর বাদক আব্দুল হোসেইন বরাজান্দে সমসাময়িক কবি ও সঙ্গীতজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করে ইরানি গীতিনাট্য ও লঘু গীতিনাট্যের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করেন। তিনি ৩০০টিরও বেশি সুর রচনা করেন, যার মধ্যে প্রায় ৩০টি পরিবেশিত হয়।
জালাল তাজ ইস্ফাহানি, বিংশ শতকের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, এ ধারা পুনর্জীবিত করেন এবং মোহাম্মদ রেজা শাজারিয়ান ও হোসেইন খোয়াজা-আমিরির মতো শিল্পীদের শিক্ষাদান করেন। তাঁর বিখ্যাত গান “আতেশ-এ-দেল” (হৃদয়ের আগুন) ফারসি কবিতার আবেগ ও কোমলতার প্রতিফলন।
বর্তমানে ডক্টর মোহাম্মদ মেহদি ভায়েজি ইস্ফাহানি, যিনি 'মোহাম্মদ ইস্ফাহানি' নামে বেশি পরিচিত, তিনি ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় সঙ্গীতের সমন্বয় করে নতুন প্রজন্মের কাছে ইরানীর শাস্ত্রীয় ধ্বনিকে পরিচিত করছেন এবং ইসফাহান সঙ্গীতের আত্মাকে জীবন্ত রাখছেন।
সুরের নগরী
ইসফাহানের সঙ্গীত আজও শহরের উদ্যানে, প্রাঙ্গণে ও মানুষের হৃদয়ে অনুরণিত হয়—এক চিরন্তন তাল, যা প্রতিটি সুরে শতাব্দীর ইতিহাস, আবেগ ও শিল্পের বোঝা বহন করে।#
পার্সটুডে/এমএআর/১৮