শিরাজ শহর: পশ্চিম এশিয়ার বিকশিত মেডিকেল ট্যুরিজম হাব
https://parstoday.ir/bn/news/iran-i153240-শিরাজ_শহর_পশ্চিম_এশিয়ার_বিকশিত_মেডিকেল_ট্যুরিজম_হাব
পার্সটুডে: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান পশ্চিম এশিয়ার অন্যতম প্রধান মেডিকেল ট্যুরিজম গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম খরচে বিশ্বমানের চিকিৎসা সেবা পাওয়ার সুযোগ থাকায় দেশটি এখন আন্তর্জাতিক রোগীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
(last modified 2025-10-20T14:16:15+00:00 )
অক্টোবর ২০, ২০২৫ ২০:০৬ Asia/Dhaka
  •  শিরাজ শহর: পশ্চিম এশিয়ার বিকশিত মেডিকেল ট্যুরিজম হাব

পার্সটুডে: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান পশ্চিম এশিয়ার অন্যতম প্রধান মেডিকেল ট্যুরিজম গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম খরচে বিশ্বমানের চিকিৎসা সেবা পাওয়ার সুযোগ থাকায় দেশটি এখন আন্তর্জাতিক রোগীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

যদিও রাজধানী তেহরানে অনেক আধুনিক হাসপাতাল ও গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে, তবে শিরাজ এখন ইরানের মেডিকেল ট্যুরিজম শিল্পের কৌশলগত কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

ফার্স প্রদেশের রাজধানী শহর হিসেবে পারস্য উপসাগরের নিকটবর্তী অবস্থান শিরাজকে প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর রোগীদের কাছে বিশেষভাবে সহজলভ্য করে তুলেছে।

সুদক্ষ চিকিৎসক, আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা এবং সাশ্রয়ী চিকিৎসা ব্যয়ের সমন্বয়ে শহরটি সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের ব্যয়বহুল স্বাস্থ্যসেবার একটি কার্যকর বিকল্প হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করছে।

মেডিকেল শিক্ষা ও গবেষণায় উৎকর্ষতার জন্য খ্যাত এই শহরে রয়েছে ইরানের অন্যতম সেরা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান 'শিরাজ ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সায়েন্সেস', যেখান থেকে বেরিয়ে আসার চিকিৎসকরা শুধু ইরানেই নয়, বরং সমগ্র অঞ্চলের হাসপাতালে কর্মরত।

কুয়েত, বাহরাইন, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে অসংখ্য রোগী নিয়মিতভাবে শিরাজে আসেন বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসার জন্য— জটিল সার্জারি থেকে শুরু করে বন্ধ্যত্ব নিরাময় পর্যন্ত।

শিরাজ ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সায়েন্সেস

শিরাজের প্রধান হাসপাতালসমূহ

শিরাজে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক রোগীদের জন্য বিস্তৃত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল নেটওয়ার্ক রয়েছে। এসব চিকিৎসা কেন্দ্র অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, উন্নত ডায়াগনস্টিক প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মাধ্যমে সর্বোচ্চ মানের সেবা প্রদান করে।

সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে 'নামাজি হাসপাতাল', যা জটিল সার্জারির জন্য জাতীয়ভাবে স্বীকৃত কেন্দ্র। অন্যান্য খ্যাতনামা হাসপাতালের মধ্যে রয়েছে 'খালিলি হাসপাতাল', 'দেনা হাসপাতাল', 'মির হোসেইনি হাসপাতাল' এবং 'ড. খোদাদুস্ত চক্ষু হাসপাতাল'— প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন, চক্ষুবিদ্যা এবং বন্ধ্যত্ব চিকিৎসার মতো বিশেষায়িত ক্ষেত্রে দক্ষতার জন্য প্রসিদ্ধ।

নামাজি হাসপাতাল

নামাজি হাসপাতাল

১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত 'নামাজি হাসপাতাল' দক্ষিণ ইরানের প্রাচীনতম ও সর্বাধিক সম্মানিত চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর একটি। এটি শিরাজ ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সায়েন্সেসের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় রোগীর জন্য উচ্চমানের চিকিৎসা সেবা প্রদান করে।

৭০০টিরও বেশি সক্রিয় বেড নিয়ে নামাজি হাসপাতাল অঞ্চলটির অন্যতম বৃহৎ স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এখানে সার্জারি, মেডিসিন, শিশু বিভাগ, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা, চক্ষু, হৃদরোগ, স্নায়ুবিদ্যা এবং ক্যানসার বিভাগসহ প্রায় সব ধরণের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়।

হাসপাতালটি বিশেষভাবে খ্যাত এর 'অঙ্গ প্রতিস্থাপন কেন্দ্র'-এর জন্য, যেখানে কিডনি, লিভার এবং হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন উচ্চ সফলতার হারে সম্পন্ন করা হয়। এছাড়া উন্নত ডায়াগনস্টিক ইউনিট, বিশেষায়িত ইনটেনসিভ কেয়ার বিভাগ এবং আধুনিক ল্যাবরেটরি সুবিধা নামাজি হাসপাতালকে পশ্চিম এশিয়ার অন্যতম রেফারেল সেন্টারে পরিণত করেছে।

খোদাদুস্ত চক্ষু হাসপাতাল

খোদাদুস্ত চক্ষু হাসপাতাল

ড. আলী আসগর খোদাদুস্ত (১৯৩৫–২০১৮) ছিলেন বিশ্বের অন্যতম খ্যাতনামা চক্ষু বিশেষজ্ঞ। শিরাজে জন্মগ্রহণকারী এই চিকিৎসক শিরাজ ইউনিভার্সিটিতে মেডিসিন অধ্যয়ন শেষে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে চক্ষুবিদ্যায় বিশেষায়ন করেন।

তিনি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন ও চোখের রোগ বিষয়ে যুগান্তকারী গবেষণা করেন এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেন।

তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হলো 'খোদাদুস্ত লাইন'— কর্নিয়া প্রতিস্থাপন প্রত্যাখ্যানের একটি ক্লিনিকাল চিহ্ন, যা আজও আধুনিক চক্ষুবিজ্ঞানে মৌলিক ধারণা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

তাঁর অবদানকে স্মরণ করে শিরাজে প্রতিষ্ঠিত হয় 'ড. খোদাদুস্ত চক্ষু হাসপাতাল', যা বর্তমানে ইরানের অন্যতম সেরা চক্ষু চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।

এখানে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন, ছানি অপারেশন, লেজার ভিশন সংশোধন, রেটিনা ও গ্লুকোমা রোগের চিকিৎসা প্রদান করা হয়, যেখানে দেশি-বিদেশি রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন।

ড. মির হোসেইনি হাসপাতাল

ড. মির হোসেইনি হাসপাতাল

১৯৮১ সালে ড. মাশাআল্লাহ মির হোসেইনি ও ড. শাহিন মুভাহেদ এই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন। মাত্র ৭০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি দক্ষিণ ইরানের অন্যতম শীর্ষ 'নারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে' পরিণত হয়েছে। হাসপাতালটি স্ত্রীরোগ, প্রসূতিবিদ্যা, বন্ধ্যত্ব চিকিৎসা ও প্রজননবিজ্ঞানে বিশেষায়িত। এর ফার্টিলিটি সেন্টার দক্ষিণ ইরানের সর্বাধুনিক কেন্দ্রগুলোর একটি, যেখানে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF) সহ নানাধরনের আধুনিক প্রজনন চিকিৎসা প্রদান করা হয়।

আধুনিক সার্জারি ইউনিট, উন্নত ল্যাবরেটরি এবং আরামদায়ক মাতৃত্ব কক্ষসমৃদ্ধ এই হাসপাতাল মা ও নবজাতকের নিরাপত্তা ও আরামের জন্য পরিকল্পিত। এখানে কর্মরত রয়েছেন অঞ্চলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ স্ত্রীরোগ ও বন্ধ্যত্ব বিশেষজ্ঞগণ, যার ফলে দেশি-বিদেশি অসংখ্য রোগী আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চিকিৎসা নিতে আসেন।

শিরাজের পর্যটন সংস্থা

শিরাজের বেশ কয়েকটি অনুমোদিত পর্যটন সংস্থা মেডিকেল পর্যটকদের জন্য বিশেষায়িত সেবা প্রদান করে। তারা রোগীর চিকিৎসা, থাকার ব্যবস্থা এবং পরিবহনসহ পুরো ভ্রমণটি সমন্বয় করে দেয়।

এই এজেন্সিগুলো হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে, চিকিৎসা সময়সূচি নির্ধারণ থেকে শুরু করে অনুবাদ সহায়তা ও রোগী-চিকিৎসকের মধ্যে যোগাযোগ সহজতর করা পর্যন্ত সবকিছু পরিচালনা করে।

অনেক এজেন্সি পরামর্শ, চিকিৎসা, সুস্থতা পরিকল্পনা এবং পরিবারের সদস্যদের জন্য শহর ভ্রমণসহ পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজও অফার করে।

বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে এবং তাদের ওয়েবসাইট ও যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে সহজেই তথ্য পাওয়া যায়, যা আন্তর্জাতিক রোগীদের জন্য শিরাজে চিকিৎসা যাত্রা পরিকল্পনা করা সহজ করে তুলেছে।

হোমা হোটেল

থাকার ব্যবস্থা এবং বিনোদনের সুযোগ

শিরাজে মেডিকেল পর্যটকদের জন্য নানা ধরণের আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। অনেক হোটেল প্রধান হাসপাতালগুলোর কাছেই অবস্থিত, যাতে রোগী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা সহজে হাসপাতালে যাতায়াত করতে পারেন।

শহরের আতিথেয়তা কেন্দ্রগুলো পরিচ্ছন্নতা, আরাম ও সেবার সৌজন্যের জন্য খ্যাত। অধিকাংশ হোটেলে শান্ত পরিবেশ, প্রতিবন্ধী-বান্ধব কক্ষ এবং সুস্থতা পুনরুদ্ধারের উপযোগী সুবিধা রয়েছে।

জনপ্রিয় হোটেলগুলোর মধ্যে রয়েছে চামরান গ্র্যান্ড হোটেল, হোমা হোটেল ও এরাম হোটেল। দীর্ঘমেয়াদি থাকার জন্য হাসপাতালের কাছাকাছি ফার্নিশড অ্যাপার্টমেন্ট ও গেস্টহাউস-ও পাওয়া যায়।

শিরাজের জলবায়ু সারা বছরই মনোরম। পারস্য উপসাগরের অনেক শহরের মতো এখানে গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া নয়, বরং শিরাজে বাতাস শীতল, নির্মল এবং আর্দ্রতা কম।

পর্বত ও উর্বর সমভূমির মাঝে অবস্থিত এই শহর চার ঋতুতেই আরামদায়ক পরিবেশ বজায় রাখে। এছাড়া এটি পরিচিত এর মনোরম বাগান, বৃক্ষশোভিত রাস্তা ও তুলনামূলকভাবে কম বায়ুদূষণের জন্য।

এরাম গার্ডেন ও আফিফ-আবাদ গার্ডেন-এর মতো সবুজ পার্কগুলো বিশ্রাম, আরাম ও আরোগ্যের জন্য আদর্শ স্থান হিসেবে জনপ্রিয়।#

পার্সটুডে/এমএআর/২০