ইসলামি বিপ্লবের ৪০ বছর: চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ ও আমেরিকার সর্বাত্মক ষড়যন্ত্র (পর্ব-৩)
(last modified Tue, 08 Jan 2019 07:36:53 GMT )
জানুয়ারি ০৮, ২০১৯ ১৩:৩৬ Asia/Dhaka
  • ইসলামি বিপ্লবের ৪০ বছর: চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ ও আমেরিকার সর্বাত্মক ষড়যন্ত্র (পর্ব-৩)

ইরানে ইসলামি বিপ্লবের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এবারে আমরা ইরানের ওপর চাপিয়ে দেয়া আট বছরের যুদ্ধের সময় ইরানের পররাষ্ট্র নীতি ও মার্কিন ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আলোচনা করব।

ইরাকের স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামি ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। আট বছর ধরে রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে জর্জরিত যে কোনো দেশ অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে কিছু নীতি নিয়ে চলে। ইরানেরও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও নীতি ছিল। চাপিয়ে দেয়া ওই যুদ্ধের সময় ইরানের পররাষ্ট্র নীতির একটি অন্যতম লক্ষ্য ছিল জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় শত্রুর হুমকি ও আগ্রাসন মোকাবেলা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা।  এ ছাড়া, জাতীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা ও ইসলামি বিপ্লবী সরকার ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা ছিল অন্যতম লক্ষ্য। ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকের যুদ্ধ শুরুর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইসলামি সরকার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা এবং সীমান্তবর্তী খুজিস্তান প্রদেশ দখল করা। যুদ্ধের শুরুতে ইরাকের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, "ইরানের ইসলামি বিপ্লবী সরকারকে উৎখাত করাই এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য।"

প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম

আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ চলাকালে ইরানের অন্যতম আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল ইসলামি বিপ্লবকে মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা ও ইরানকে একটি মডেল বা আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা। 

কিন্তু এটাকে শত্রুরা প্রচারণার কাজে ব্যবহার করে এবং আরব দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের দায়ে ইরানকে অভিযুক্ত করতে থাকে। তারা এটাও প্রচার করে ইরান বিপ্লব রপ্তানির চেষ্টা করছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে ইরান এ বিপ্লবের মাধ্যমে নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে যা শত্রুর আগ্রাসন মোকাবেলায় অন্য দেশগুলোর জন্যও হবে একটি দৃষ্টান্ত। ইরানের বিচারবিভাগের মানবাধিকার বিষয়ক উচ্চ পরিষদের সচিব মোহাম্মদ জাওয়াদ লারিজানি এক টুইট বার্তায় বলেছেন, এ বিপ্লব আমাদের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যেই থাকবে এবং ইরান যদি সমৃদ্ধ হয় তাহলে তা হবে প্রকৃত ইসলাম প্রচারে সর্বোত্তম উপায়।

জাওয়াদ লারিজানি 

১৯৮১ সালে ছয়টি আরব দেশ নিয়ে পারস্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা পিজিসিসি গঠিত হয়। সে সময় তারা বলেছিল ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রভাব ও প্রচার ঠেকানোই এ জোট গঠনের উদ্দেশ্য।

ইরানের বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের সময় একমাত্র সিরিয়া ছাড়া অন্য সব দেশ ইরাককে সহযোগিতা করেছিল। যুদ্ধের পরও আরব দেশগুলো ইরাকের সাদ্দামকে সহযোগিতা দেয়া অব্যাহত রাখে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে পারস্য উপসাগরের পানিসীমা থেকে ইরাক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে সেসময় পিজিসিসিভুক্ত আরব দেশগুলো ইরাকের প্রতি সহযোগিতার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আমেরিকার সমর্থন নিয়ে এ দেশগুলো ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি শত্রুতা করতে থাকে। এরই অংশ হিসেবে ১৯৮৭ সালে হজের সময় বহু ইরানি হাজিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল সৌদি সরকার।

পিজিসিসি

পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে ইসলামি ইরানের আরেকটি নীতি হচ্ছে প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের কোনো বৃহৎ শক্তির ওপর ভরসা না করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো।

মার্কিন নেতৃত্বে পাশ্চাত্য এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে  প্রাচ্যের শক্তিকে ইরান সাম্রাজ্যবাদী হিসাবে মনে করত। এই দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে ইরান একাই রুখে দাঁড়িয়েছিল। তবে একটি শক্তির পতনের পর আরেকটি শক্তির কাছ থেকে কখনো কোনো সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করেনি ইরান সরকার। বরং ইরান নিজের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং পরাশক্তিগুলোর ওপর থেকে নির্ভরতা না করার নীতিতে অটল থাকে। ইরানের বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের সময় আমেরিকা ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরাকের সাদ্দামকে সহযোগিতা করেছিল। এমনকি ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে ওয়াশিংটন বাগদাদকে উস্কানি দিয়েছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয় ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের হাতে মার্কিন কূটনীতিক আটকের ঘটনা আমেরিকার সমস্ত অহংকার চুরমার করে দিয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ও জনতার হাতে আটক মার্কিন কূটনীতিক

ইরানে বিপ্লবের কারণে একদিকে আমেরিকা ইরানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হারায় অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ও জনতার হাতে আটক কূটনীতিকদের উদ্ধারে ব্যর্থতার কারণে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমেরিকার দুর্বলতা ফুটে ওঠে যা ছিল তাদের জন্য খুবই অবমাননাকর।

এ কারণে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে নিজে আস্থা ও মান-মর্যাদা ফিরিয়ে আনার জন্য ইরাককে দিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইয়্যেদ দাউদ অগাই তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, আফগানিস্তানে ইরানের প্রভাব এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মুসলিম প্রধান এলাকায় ইরানি বিপ্লবের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে উদ্বেগের কারণে সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছিল। তাই বলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরানের ইসলামি সরকারের পতন চায়নি। কিন্তু কূটনীতিক আটকের ঘটনায় আমেরিকার মর্যাদা মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ায় এবং বিশ্বঅঙ্গনে আমেরিকার শক্তি ও গ্রহণযোগ্যতা হুমকির মুখে পড়ায় তারা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরাককে উস্কানি দেয়। এ যুদ্ধে আমেরিকা সাদ্দামকে সবরকম সহযোগিতা দিয়ে ইরানের ইসলামি সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টা করেছিল।

কিন্তু তারপরও তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইরানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী রাজাইকে পাঠানো এক বার্তায় দাবি করেছিলেন, ইরাক-ইরান যুদ্ধে ওয়াশিংটন নিরপেক্ষ রয়েছে। ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইয়্যেদ জালাল দেহকানি ফিরোজাবাদি এক নিবন্ধে লিখেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে আমেরিকা খুবই খুশী ছিল। কারণ তারা নিশ্চিত ছিল ইরানকে পরাজিত করা যাবে এবং তারা নতজানু হবে। কিন্তু আমেরিকার সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।

যাইহোক, যুদ্ধ চলাকালে ইরানের বিপ্লবী যোদ্ধারা ইরাকের কাছ থেকে ফাও দ্বীপের নিজের অংশ পুনরুদ্ধার করলে তৎকালীন দুই পরাশক্তি ভয় পেয়ে যায় এবং তারা ইরাকের প্রতি সহযোগিতার হাত দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। ইরানিরা সীমান্তবর্তী ফাও দ্বীপের নিজের অংশ পুনরুদ্ধার করলে এ যুদ্ধে ইরানের বিজয় ঠেকানোর জন্য দুই পরাশক্তি মরিয়া হয়ে ওঠে।

একদিকে যুদ্ধের ময়দানে ইরানের বিজয় অন্যদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে ইরানের যৌক্তিক ও শক্তিশালী অবস্থানের কারণে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে এসে আমেরিকা সরাসরি ইরাককে সহযোগিতা দেয়।

কারণ ইরানের এ বিজয়কে কিছু কারণে মার্কিন স্বার্থের জন্য হুমকি বলে মনে করে মার্কিন কর্মকর্তারা। প্রথমত, ইরানের বিজয় মানেই পাশ্চাত্যে জ্বালানি সরবরাহ হুমকি মুখে পড়তে পারে। দ্বিতীয়ত, মার্কিন মিত্র আরব দেশগুলোর নিরাপত্তা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। আর তৃতীয়ত, আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরাইলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। চতুর্থত, সার্বিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য ও পারস্য উপসাগর এলাকায় মার্কিন স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব কারণে আর্থ-রাজনৈতিক ও সামরিকসহ সমস্ত শক্তি ব্যবহার করে আমেরিকা ইরানের বিজয় ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন

 

ট্যাগ