ফার্সি নববর্ষ- নওরোজ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান (এক)
নওরোজ উপলক্ষে আপনাদের সবাইকে বাসন্তি অভিনন্দন জানাচ্ছি। ফার্সি 'নও' মানে নতুন আর 'রোজ' মানে দিন। তাহলে নওরোজ মানে দাঁড়ায় নতুন দিন। প্রত্যেক রাত্রি শেষে সূর্য উঠলেই নতুন দিন। কিন্তু ইরানে এই নওরোজ একটি পরিভাষা।
প্রতিটি নতুন দিনই নওরোজ নয়। বরং ফার্সি ক্যালেন্ডারে বছরের প্রথম দিন কিংবা নববর্ষ উপলক্ষে যে-কয়দিন ছুটি থাকে, সে কয়দিনই নওরোজ। অন্যভাবে বলা যায় বসন্তের সূচনাই ইরানে নওরোজ। এই নওরোজ বা নববর্ষ বরণের সংস্কৃতি যে কতোটা প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী ইরানে, তা নওরোজ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত না হলে বোঝা যাবে না। বলা বাহুল্য ইরানে সবচেয়ে বড় উৎসব হলো নওরোজ উৎসব।
সেই নওরোজ এখন সমাগত দ্বারে। বসন্ত বরণ এবং নওরোজ উৎসব একত্রেই পালিত হয় ইরানে। বসন্তের সূচনায় প্রকৃতিতে যে পরিবর্তন ঘটে সেই পরিবর্তন মানুষ নিজেদের মনেও ঘটাতে চায়। বাংলায় একটি পংক্তি আছে-ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত। ইরানের বেলায় কেন যেন এই সংশয়টি কাজ করে না। বসন্ত এসেছে অথচ ফুল ফোটে নি-এমনটা ঘটতে খুব একটা দেখা যায় না ইরানে। বসন্ত আর নওরোজকে বরণ করে নেওয়ার কিছু ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি রয়েছে এখানে।
পুরোনো বছরের শেষ দিকে ক্লান্তির নি:শ্বাস ফেলে বিদায়ের প্রস্তুতি নেয় দিনগুলো। নতুনের ডামাডোলে সেই ক্লান্তি, শ্রান্তি, জড়তা কেটে যেতে থাকে। জনগণ প্রকৃতির শ্যামলিমা নিজেদের ঘরে, আশেপাশে, অফিস-আদালত কিংবা কর্মস্থলেও গড়ে তোলার চেষ্টা করে। পুরোণো বছরের শেষ কটা দিনে তাই চলে সবুজের আবাহন। এই সবুজ মনোদৈহিক জাগৃতি আর নবীনতার প্রতীক। সতেজ, সজীব হয়ে ওঠার একান্ত মনোবাসনা ধরা দেয় এই সবুজের আয়োজনে। গম কিংবা মাশকলাই অথবা ডাল ভিজিয়ে সবুজ চারা বানানো হয় ঘরে ঘরে। বিচিত্র উদ্ভিদে প্রাকৃতিক সুন্দর পরিবেশ তৈরি করা হয় বাড়িঘরে। বিশ্বের যে প্রান্তেই ইরানিরা বসবাস করুক না কেন নওরোজের এই সংস্কৃতি সবার ঘরে ঘরে পালন করা হয়। বসবাসের স্থানেই তারা ইরানের এই চমৎকার সংস্কৃতি চর্চা করে। এভাবে সবুজের আবহ তৈরি করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইরানিরা স্বাগত জানায় ঐতিহ্যবাহী 'নওরোজ'কে।

এরপর চলে ঘরবাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান। ইরানিরা এমনিতেই ভীষণরকম পরিচ্ছন্ন জাতি। নওরোজ উপলক্ষে সেই পরিচ্ছন্নতায় যুক্ত হয় নতুন নতুন আকাঙ্ক্ষা ও মনযোগ। কেউ রঙ করে। সামর্থ্য অনুযায়ী কেউ ঘরের আসবাবপত্র পাল্টায়। কেউবা ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন বা ঘরের অভ্যন্তর সজ্জায় পরিবর্তন এনে সবকিছু নতুন করে সাজায়। এটাকে নওরোজের পরিভাষায় 'খনে থেকনি' বলে। খনে মানে ঘর আর থেকনি মানে হলো ঝাঁকুনি দেওয়া। তার মানে কোনো কিছুর পর ময়লা, ধুলোবালি পড়লে যেভাবে আমরা ঝাড়া দিয়ে পরিষ্কার করার চেষ্টা করি, ঠিক সেরকম ঝেড়েমুছে ঘর পরিষ্কার করার নামই খনে থেকনি। তবে শুধু ঝেড়েই শেষ করা হয় না বরং ধুয়েমুছেও পরিচ্ছন্ন করা হয় বিগত বছরের সব ধুলোবালি, ময়লা-আবর্জনা, জরা-জীর্ণতা। সারা দেশ জুড়ে এই পরিচ্ছন্নতা অভিযান চলার ফলে পুরো দেশটাই নতুন ঝকমকে হয়ে ওঠে। নওরোজে তাই সত্যিকার অর্থেই নতুন আমেজ তৈরি হয় ইরানিদের মাঝে।
পরিচ্ছন্নতার কথা বলছিলাম। আমরা তো সাধারণত কোনো অতিথির আগমনে ঘরবাড়ি এমনিতেই পরিষ্কার করার চেষ্টা করি। নওরোজে সবার বাড়িতেই মোটামুটি আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের আগমন ঘটে। তাই সার্বক্ষণিক পরিচ্ছন্নতার আয়োজন চলে। এর মাধ্যমে মানুষের মনেও আসে এক ধরনের পবিত্রতা। সবুজের নবজন্মে বিশ্বাসে আসে নতুন মাত্রা। যারা পুনরুজ্জীবন কিংবা পরকালীন জীবনে বিশ্বাস করে তাদের বিশ্বাসের পালে লাগে নতুন হাওয়া। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাকে ঈমানের অংশ বলা হয়েছে ইসলামে। একইভাবে পরকালীন জীবনে বিশ্বাসও ঈমানের অংশ। নওরোজ উৎসবকে ইরানে ঈদে নওরোজ বলে অভিহিত করা হয়। তবে এই ঈদের সঙ্গে ইসলামের ঈদকে মেলানো চলবে না। কারণ ইরানে যে-কোনো উৎসবকেই 'ঈদ' বলা হয়। তবে ঈদের সঙ্গে একটা মিল আছে। সেটা হলো কেনাকাটার ধুম পড়ে যায় নওরোজের কিছুদিন আগে থেকেই। বাজার-ঘাটগুলো তাই জনারণ্যে পরিণত হয়ে ওঠে।

এর আরেকটি কারণ হলো নওরোজ উপলক্ষে প্রাচীনকাল থেকেই ইরানে দীর্ঘ ছুটির ব্যবস্থা ছিল। সেই ব্যবস্থা ইসলামি বিপ্লব পরবর্তীকালেও অনেকটাই বজায় রয়েছে। সেজন্য ছুটিতে বাজারঘাট বন্ধ থাকে। বন্ধের দিনগুলোতে বাজারের চাহিদা মেটাতে নওরোজের আগেভাগে জমজমাট হয়ে পড়ে রাস্তা-ঘাট,হাট-বাজার। নতুন জামা-কাপড় থেকে শুরু করে ঘরের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়। প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে সবাই নতুন জামা পরার চেষ্টা করবে-এটাই স্বাভাবিক। নবীন কিশলয় যেরকম ঝকমকে প্রতিবিম্ব ছড়ায় নতুন জামার আয়োজনেও দেশজুড়ে সেরকম নতুনের আমেজ লক্ষ্য করা যায়। মাটির চেহারা সবুজের আগমনে, এই বসন্তে যেভাবে পাল্টে যায়, প্রকৃতির সেই রূপ ইরানিরা তাদের পোশাক-আশাকেও চর্চা করে। বসন্তের আগমনে তাই প্রতিটি ইরানির মনেও স্বাভাবিকভাবেই বিরাজ করে সবুজ সতেজ আনন্দময় বসন্তের উচ্ছ্বাস এবং নির্মল প্রশান্তি।
বুট-বাদাম, পেস্তা, আখরোট, ফল-ফুলের বিচি জাতীয় শস্যদানা খাওয়ার প্রচলন ইরানে বেশ প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে। নওরোজে প্রায় প্রতিটি ইরানির ঘরেই এগুলোর সংগ্রহ লক্ষ্য করা যাবে। নওরোজের ছুটির অবসরে বেড়াতে যাওয়া ইরানিদের একটা ঐতিহ্য। যেখানেই বেড়াতে যাবে এই শস্যদানা খাওয়ার চেষ্টা চলবে। গল্প-গুজবের ফাঁকে শস্যবীচির সঙ্গে চা খাওয়ার প্রচলন ইরানিদের মাঝে সহজলক্ষ্য। 'হাফত-সিন' সংস্কৃতি নওরোজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সিন দিয়ে শুরু হয়েছে-এরকম সাতটি জিনিস দিয়ে ঘরে ঘরে টেবিল সাজানোর প্রথাই হলো হাফত-সিন সংস্কৃতি। এর বিভিন্ন প্রতীকী অর্থ রয়েছে। কেউ কেউ সিন দিয়ে শুরু সাতটি খাবার দিয়েও হাফত-সিন সাজায়। যেমন: সোমগ-এক ধরনের পাহাড়ি গাছের ফলের গুঁড়ো, সির মানে রসুন, সিব মানে আপেল, সানজেদ-এটাকে রাশিয়ান অলিভও বলা হয়, সামানু-গমের চারার শাস দিয়ে তৈরি এক ধরনের খাবার, সেরকেহ মান সিরকা এবং সাবজেহ মানে সবুজ চারা।
হাফত-সিনের টেবিলে এই সাতটি জিনিসের পাশাপাশি কুরআনে মাজিদ, পানি, গোল্ড ফিশ এবং ডিমও রাখা হয়। আরও রাখা হয় বিচিত্র মিষ্টি ও শুকনো ফল। ইরানি মিষ্টি শুকনো বলে দীর্ঘদিন থাকে, নষ্ট হয় না। এই হলো মোটামুটি ইরানি হাফত-সিন সংস্কৃতি। তবে অঞ্চলভেদে এতে অন্যান্য সংযোজনি কিংবা বিয়োজনও লক্ষ্য করা যায়। বাড়ির মহিলারাও নওরোজ উপলক্ষে বিভিন্ন রকমের খাদ্য সামগ্রী তৈরি করে থাকেন। নওরোজ উপলক্ষে তরুণ-তরুণীদের মাঝে বিয়ের একটা সংস্কৃতি লক্ষণীয়। যে মেয়ের সঙ্গে এঙ্গেইজমেন্ট হয়েছে সেই পাত্রীর বাসায় নওরোজের আগমনে কিছু উপহার সামগ্রী পাঠানো হয়। এই উপহারকে 'এইদুনে' বলে অভিহিত করা হয়। এইদুনে মানে হলো ঈদ উপহার। নতুন জামা, মিষ্টি, বাদাম জাতীয় পণ্য, সামানু কিংবা স্বর্ণ ইত্যাদি এইদুনের অন্তর্ভুক্ত থাকে। পাত্রীপক্ষও পাত্র পক্ষকে নওরোজের রাতে আমন্ত্রণ জানায়। সেইসঙ্গে জামা-কাপড় ইত্যাদি উপহার দেয়।
মৃতদের কবর জিয়ারত করা, স্বজনদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করা ইত্যাদিও নওরোজ সংস্কৃতির অংশ। যারা আর্থিকভাবে দুর্বল তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসাটাও একটা প্রচলিত রীতি। সেই সঙ্গে বছর শুরুর একেবারে সূচনালগ্নে একটি দোয়া করা হয়। যেই দোয়াটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই দোয়ার মধ্য দিয়েই আমরা পরিসমাপ্তি টানবো নওরোজ উপলক্ষে আয়োজিত এই আসরের। দোয়াটি হলো:
یا مقلب القلوب و الابصار یا مدبرالیل و النهار یا محول الحول و الاحوال حول حالنا الی احسن الحال.
“হে অন্তর ও দৃষ্টির পরিবর্তনকারী এবং দিন ও রাতের পরিচালনাকারী এবং অবস্থার পরিবর্তনকারী (মহান আল্লাহ)! আমাদের অবস্থাকে সর্বোত্তম অবস্থায় রূপান্তরিত করুন।”
চমৎকার এই দোয়াটি আমাদের সবার জীবনে বয়ে আনুক ইতিবাচক পরিবর্তন। এ প্রত্যাশা রইলো। পরিসমাপ্তি টানবো বসন্তের কটি পংক্তি দিয়ে:
পাখিদের ওই নৃত্য গান আর কল-কোলাহল দেখে
বলছে সবাই খুলে মন-দোর : বসন্ত এসে গেছে
ওঠো! আলিঙ্গনে করে নাও তারে বরণ
বাসন্তি প্রবাহে সে যে প্রকৃতির পরাণ
এ লগ্নের তিক্ততায় বোজো জাগ্রত আঁখি
বসন্ত এসেছে মিষ্টি স্বপ্নের ঘোর মাখি।
সবাইকে আবারও নওরোজের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/২০
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন