ইরানি বিপ্লব প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আধিপত্যকামিতা উপেক্ষা করেই টিকে আছে
ইরানে ইসলামী বিপ্লব সারা দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছে যেসব কারণে তার অন্যতম হল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কোনো পরাশক্তির সহায়তা না নিয়েই এ মহাবিপ্লব সংঘটিত হয়।
শুধু তাই নয় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আধিপত্যকামিতা ও রক্ত-চক্ষু উপেক্ষা করেই এ বিপ্লব বিশ্বের বুকে স্বাধীন, ইসলামী ও মানবতাবাদী আন্তর্জাতিক পররাষ্ট্রনীতি ও রাজনীতির ধারা চালু করতে সক্ষম হয়। বৈদেশিক নীতিসহ সব নীতির ক্ষেত্রেই ইসলামী ইরান বিশ্বের সবচেয়ে স্বাধীন ও মুক্তিকামী রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাব সৃষ্টি করে চলেছে। 'প্রাচ্যও নয় এবং পাশ্চাত্যও নয়, ইসলামই শ্রেষ্ঠ'- ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনি (র) কেবল ইরানিদের কাছেই এই শ্লোগানকে জনপ্রিয় করতে পেরেছিলেন তা নয়, বিশ্ববাসীর কাছেও এই শ্লোগানকে একটি আদর্শ ও বাস্তবায়নযোগ্য নীতি বা শ্লোগান হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পরাশক্তিগুলোর সহযোগিতা ছাড়া কোনো আদর্শ বা বিপ্লব শক্তিশালী রাষ্ট্র-ব্যবস্থার অধিকারী হতে পারে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তিমত্তা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে- এমন ধারণাকে অবাস্তব বা আকাশকুসুম কল্পনা বলে মনে করা হত বিগত শতকে। কিন্তু ইরানের ইসলামী বিপ্লব এই ধারণাকে মারাত্মক ভুল বলে প্রমাণ করেছে।
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের ফলে দেশটির ওপর যেমন পশ্চিমা শক্তিগুলোর আধিপত্যের পথ রূদ্ধ হয়ে যায় তেমনি তৎকালীন সোভিয়েত ব্লকের প্রভাব বা আধিপত্যও শেষ হয়ে যায়। বিশ্বের বহু দেশ ইরানের ইসলামী বিপ্লবের স্বাধীনচেতা পররাষ্ট্রনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং কোনো কোনো অমুসলিম দেশও এই বিপ্লব থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনুপ্রেরণা নিয়ে মার্কিন আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। আর এ কারণেই এসব দেশের সঙ্গে ইসলামী ইরানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভেনিজুয়েলা এসব দেশের অন্যতম।
ইসলামের শত্রুদের সম্পর্কে ইমাম খোমেনী (র) ছিলেন তার পূর্বপুরুষ মহানবীর (সা) অনুসারী এবং অবিচল পাহাড়ের মতই আপোষহীন ও অনমনীয়। আর সে জন্যই তিনি দৃঢ়চিত্তে বলতেন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পরাশক্তিগুলোর মতবাদ নয় বরং ইসলামই শ্রেষ্ঠ। তিনি একদিকে যেমন মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী চক্রকে চরম ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন তেমনি তিনি মোটেও আপোষ করেননি সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ব্লকের সঙ্গেও। বড় শয়তান আমেরিকার সঙ্গে সংগ্রামের পাশাপাশি তিনি আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনেরও বিরোধিতা করেছেন। সমাজতন্ত্র যে কেবল জাদুঘরে ঠাঁই পাবে সেই ভবিষ্যদ্বাণীও তিনি করে গেছেন নিখুঁতভাবে!

প্রখ্যাত ফরাসি চিন্তাবিদ মিশেল ফুকো ইরানের ইসলামী বিপ্লব পরিদর্শনে এসেছিলেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এবং জনগণের ঐক্য ও সংহতি দেখে তিনি অভিভূত হয়েছেন। তিনি তাঁর 'নিষ্প্রাণ বিশ্বের প্রাণ ইসলামী বিপ্লব' নামক গ্রন্থে লিখেছেন-"বাস্তবতা হলো এই বিপ্লবী ঘটনার উদাহরণ ইতিহাসে বিরল। কারণ এই বিপ্লবে পুরো একটি জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে।" তিনি আরো বলেছেন, "আধ্যাত্মিকতা ছিল ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মূলভিত্তি। এ বিপ্লব পুরনো চিন্তাধারার প্রতি ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করেছে। এ বিশেষত্ব ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে বিশ্বের অন্যান্য বিপ্লব থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করেছে এবং নিজেই একটি আদর্শে পরিণত হয়েছে।"
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের আরেকটি বড় সাফল্য হল এই মহাবিপ্লব ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে জনগণের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়নি। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের সময় ইমাম খোমেনি (র) এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে তিনি ইচ্ছা করলে জনগণের ওপর জোর করে ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে গণভোট নিয়েছিলেন। জনগণ তথা প্রায় ৯৮ শতাংশ ভোটার যখন ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে ভোট দেয় তখন তিনি এর সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্বও অর্পণ করেন জনগণের নির্বাচিত বিশেষজ্ঞ পরিষদের ওপর। এই পরিষদও তার প্রণীত সংবিধানকে জোর করে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়নি। বরং এই সংবিধানের প্রতি সমর্থন যাচাই করতেও গণভোট দেয়া হয়। আর ইরানি জনগণও এই সংবিধানের প্রতি সমর্থন জানায়।
এভাবে ইরানের ইসলামী সরকার-ব্যবস্থাকে বিশ্বের সবচেয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এই ব্যবস্থায় কেবল সংসদ সদস্যরাই জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন তা নয়। সংসদের উচ্চ কক্ষ তথা বিশেষজ্ঞ পরিষদও জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়। আর এই পরিষদই নির্বাচন করেন দেশের সর্বোচ্চ নেতা। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে প্রায় প্রতি বছরই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছাড়াও পৌরসভার প্রতিনিধি নির্বাচনের ভোটেও অধিকাংশ ভোটারই অংশ নিয়ে থাকে। এভাবে যুগ যুগ ধরে যে দেশে জনগণ ছিল উপেক্ষিত এবং যেখানে ছিল রাজতান্ত্রিক শাসন সেখানে এখন জনগণই নিজ ভাগ্য নির্ধারণ করছে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে। নির্বাচন ব্যবস্থা ইরানের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ককে অনেক নিবিড় করে তুলেছে। ইরানের নির্বাচনগুলো এতই স্বচ্ছ, স্বতস্ফূর্ত ও উচ্চ মানের যে তার তুলনা করার মত নির্বাচন বিশ্বে খুব কমই দেখা যায়।#
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/০৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।