'সত্যের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে রেডিও তেহরানকে আমি আবিষ্কার করেছি'
(last modified Tue, 04 Apr 2023 04:28:53 GMT )
এপ্রিল ০৪, ২০২৩ ১০:২৮ Asia/Dhaka
  • 'সত্যের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে রেডিও তেহরানকে আমি আবিষ্কার করেছি'

‘আইআরআইবি ফ্যান ক্লাব বাংলাদেশ'-এর দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। ওই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিজয়ী হয়েছেন ৯ জন। বিজয়ীদের পাশাপাশি অংশগ্রহণকারীদের গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলো পার্সটুডেতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হবে। আজ প্রকাশিত হলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ফেমিলি রেডিও লিসনার্স ক্লাবের সভাপতি নিজামুদ্দিন সেখ-এর লেখা।

১৯৮২ সাল। মাধ্যমিক পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছি বিজ্ঞান বিভাগে। পড়াশোনার যথেষ্ট চাপ থাকা সত্ত্বেও রেডিও শোনার নেশা কিন্তু ছাড়তে পারিনি। এরই মধ্যে বিবিসি'র বদৌলতে ইরান- ইরাক যুদ্ধের খবর আমাদের এই প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে গেছে। সন্ধ্যা ৭টা বাজলেই নিজ বাড়িতে, কী মুদির দোকান, কী চায়ের দোকান সর্বত্র মানুষের ভিড় বিবিসি'র খবর শোনার জন্য। কারণ একটাই। ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন যুদ্ধে কতটা জয়লাভ করল, কতটা ইরানের জায়গা দখল করল- তা জানা। প্রায় সমস্ত গ্রামবাসী শিয়া নেতা ইমাম খোমেনিকে সাপোর্ট না করে সুন্নী নেতা সাদ্দাম হোসেনকে সাপোর্ট করতো। কিন্তু এই যুদ্ধ কেন হচ্ছে? এই যুদ্ধের জন্য কে দায়ী সে সব জানার চেষ্টা তারা করতো না। জানার চেষ্টা করতো না এই যুদ্ধের পিছনে কাদের ইন্ধন রয়েছে।

আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিবিসি, ভিওএ ইত্যাদি কয়েকটি বেতারকেন্দ্র থেকে এই যুদ্ধের সঠিক কারণ ও ফলাফল জানার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। কারণ এই সব বেতার কেন্দ্রগুলো ছিল পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। ফলে আসল তথ্য জানার জন্য রেডিওর নব ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করে ফেললাম রেডিও তেহরানকে। শুনতে থাকলাম নিয়মিত অনুষ্ঠান। বেশ কিছুদিন অনুষ্ঠান শোনার পর জানতে পারলাম যুদ্ধের আসল কারণটা। আসলে ইমাম খোমেনি ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাইনি। এ যুদ্ধ ছিল ইরাকের পক্ষ থেকে ইরানের উপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ। যার নেপথ্যে ছিল আমেরিকা, ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন।

এর পর থেকে আমি প্রত্যেকদিন রেডিও তেহরানের অনুষ্ঠান বিশেষ করে এর বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ বিশ্বসংবাদ গ্রামের শিক্ষিত মানুষদের শোনাতাম। ইরান-ইরাক যুদ্ধের আসল তথ্য মানুষদের বোঝাতাম। বলতে গেলে এভাবেই সত্যের উৎস সন্ধানে রেডিও তেহরানকে আমি আবিষ্কার করেছি এবং এর একজন ভক্ত শ্রোতা হয়ে উঠেছি। এর পর যখন শ্রোতা হিসেবে আমি বাংলা নিউজ লেটার এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাপ্তাহিক বাংলা বুলেটিন নিয়মিত পেতে শুরু করলাম তখন তা নিজের পড়ার পাশাপাশি গ্রামের শিক্ষিত মানুষদেরও পড়াতে লাগলাম এবং নিউজ লেটারে প্রকাশিত ইরাকের রাসায়নিক হামলায় হতাহত ইরানি সৈন্যদের ছবিগুলো যখন তাদের দেখাতে লাগলাম তখন তাদের মনের মধ্যে যে ভুল ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল তা ক্রমশ দূর হতে শুরু করল এবং রেডিও  তেহরানের বাংলা অনুষ্ঠানের প্রতি তারা ধীরে ধীরে আকৃষ্ট হতে লাগলো।

আমার গ্রামে এস এম জাকির হোসেন, এস এম এ সুফিয়ান বাবু, নাসিরুদ্দিন আহমেদ, গাকুন্দা গ্রামে মতিউর রহমান, গজধর পাড়ার নুর ইসলাম সাহেব প্রমুখকে রেডিও তেহরানের একনিষ্ঠ ভক্ত শ্রোতা ও নিয়মিত পত্রলেখকে পরিণত করতে সমর্থ হয়েছিলাম। সংসার জীবনের নানান ব্যস্ততার কারণে এদের কেউ কেউ রেডিও থেকে একটু দূরে রয়েছে, কেউ পাড়ি দিয়েছে না ফেরার দেশে, আবার কিছু সংখ্যক এখনও সাথে আছে রেডিও তেহরানের বাংলা অনুষ্ঠানের সঙ্গে। তাদেরকে পুরোপুরিভাবে রেডিও তেহরানের বাংলা অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য গত ৪ঠা ডিসেম্বর হাটগাছা শিশু মাদ্রাসায় নাজিম ভায়ের ডাকা শ্রোতাদের সঙ্গে মত বিনিময় সভায়  উপস্থিত ও করিয়ে ছিলাম।

রেডিও তেহরানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এর শ্রোতা বান্ধব প্রীতি ও পক্ষপাতিত্বহীন ব্যবহার। রেডিও তেহরান এপার এবং ওপার বাংলার সকল শ্রোতাদের নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকে কিন্তু অন্যান্য বেতার কেন্দ্রগুলো সেই নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারেনি। এর বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ বিশ্ব সংবাদের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সংবাদগুলোও আমরা জানতে পারি যা বিশ্বের অন্য কোনো  বেতার কেন্দ্র থেকে আমরা পাই না। তাছাড়া রেডিও তেহরান সব বয়সের, সব রকম চাহিদার শ্রোতাদের কথা মাথায় রেখে অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে যা তার সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায়।

মহান আল্লাহর পবিত্র কালাম পাক পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করার পাশাপাশি বিশ্ব সংবাদ, দৃষ্টিপাত, আসমাউল হুসনা, সুখের নীড়, রংধনু আসর, স্বাস্থ্যকথা, গল্প ও প্রবাদের গল্প, সুন্দর জীবন, ইরান ভ্রমণ, কুরআনের আলো, নারী: মানব ফুল, আলাপন, জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইরানিদের অবদান, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস সর্বোপরি সবার প্রিয় প্রিয়জন অনুষ্ঠান সব বয়সের সব চাহিদার শ্রোতাদের মনের খোরাক জোগাতে সক্ষম হয়েছে বলে আমার মনে হয়।

বর্তমানে একদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নও অপরদিকে আর্থিক বাজেট ঘাটতি দেখিয়ে যখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশ তাদের রেডিও সম্প্রচার বন্ধ করে দিচ্ছে তখন  মার্কিন  সাম্রাজ্যবাদের মদতে ইরানের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও রেডিও তেহরান তার রেডিও সম্প্রচার বন্ধ তো করেইনি, বরং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বোঝা মাথায় নিয়েই শ্রোতাদের স্বার্থে কিভাবে একে ঢেলে সাজাতে হয় তা করে দেখিয়েছে। এবং আগামীতে ও তা আরও প্রাণবন্ত করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে  যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। কারণ রেডিও তেহরান তার দুরদর্শিতার মধ্য দিয়ে মনে করে রেডিও ছিল, আছে এবং আগামীতেও থাকবে।

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার  "সভ্যতার প্রতি " কবিতায় লিখেছেন -

দাও ফিরে সেই অরণ্য, লও এ নগর,

লও যত লৌহ লৌষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর।

হে নব সভ্যতা!  হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী....

 

ঠিক  তেমনি ভাবে জনগণ একদিন বলবে-

দাও ফিরে সেই রেডিও, লও এ স্মার্ট ফোন

লও যত ইন্টারনেট, ডিজিটাল টেলিভিশন।

হে উন্নত প্রযুক্তি! হে নিষ্ঠুর হে যুব সমাজ গ্রাসী আর সেদিন হয়তো খুব দূরে নয়।

 

লেখক:

নিজামুদ্দিন সেখ ('বি' ক্যাটাগরিতে বিজয়ী)

সভাপতি, ফেমিলি রেডিও লিসনার্স ক্লাব

গ্রাম: নওপাড়া, পোস্ট: নওপাড়া শিমুলিয়া

জেলা: মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত।

 

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/৪