কোথায় জাগ্রত মুসলিম ও বিশ্ব-বিবেক!!?
ইয়েমেনে সৌদি জোটের ১৯০০ দিনের আগ্রাসন ও গণহত্যার রহস্য!
-
ইয়েমেনে সৌদি যুদ্ধ-অপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের ব্যাপারে নীরব পাশ্চাত্য ও নিষ্ক্রিয় জাতিসংঘ
ইয়েমেনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে আগ্রাসন চালিয়ে আসছে পশ্চিমা মদদপুষ্ট সৌদি-জোট। অন্য কথায় এ আগ্রাসনের ১৯০০ দিন পার হল!
যে সৌদি আরবে গণতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা ও ধর্মীয়-স্বাধীনতা বলতে কিছুই নেই এবং মানবাধিকার বলতেও বাস্তবে তেমন কিছুই নেই সেই রাজতান্ত্রিক সৌদি সরকার ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ থেকে দারিদ্র-পীড়িত ইয়েমেনে আগ্রাসন চালিয়ে আসছে!
ইয়েমেনি সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র বলেছেন, গত ৯ এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত ইয়েমেনে সৌদি জোট দুই হাজার ৪১ বার বিমান হামলা চালিয়েছে। মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে ইয়েমেনের মানুষ যখন নানা সমস্যার মধ্যে রয়েছে ঠিক তখনি সামরিক হামলার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে সৌদি আরব।
ইয়েমেন-বিরোধী সৌদি জোটের শরিক আরব দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, সুদান ও কয়েকটি ক্ষুদ্র দেশ। ইয়েমেনের ওপর এই দেশগুলোসহ গোটা পাশ্চাত্য ও তাদের মিত্র দেশগুলো চাপিয়ে দিয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। এমনকি তারা জাতিসংঘকেও ব্যবহার করছে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে! এইসব শক্তি ইয়েমেনের যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ-কবলিত অঞ্চলের জনগণের কাছে খাদ্য ও জরুরি ত্রাণ সরবরাহেও বাধা দিচ্ছে।
ইয়েমেনের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সৌদি আরবের কাছে পশ্চিমা দেশগুলো প্রতি বছর বিক্রি করছে হাজার হাজার কোটি ডলারের গণ-বিধ্বংসী ও এমনকি নানা ধরনের নিষিদ্ধ অস্ত্র। এইসব অস্ত্রের নির্বিচার প্রয়োগে হতাহত হয়েছে হাজার হাজার বেসামরিক ইয়েমেনি নাগরিক। হতাহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। বিয়ে-বাড়ীর সমাবেশ, শোক-সমাবেশ ও শিশুদের স্কুল-বাসও রেহাই পাচ্ছে না নির্বিচার হামলা থেকে।
ইয়েমেনের বিপুল সংখ্যক শিশু হত্যায় সৌদি রেকর্ডের কারণে জাতিসংঘ সৌদি সরকারকেও শিশু-ঘাতক সরকারগুলোর কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল। আইনুল ইনসানিয়ে নামের একটি নাগরিক সংস্থা জানিয়েছে, ইয়েমেনে সৌদি জোটের আগ্রাসনে ১৬ হাজার ৬৭২ বেসামরিক ইয়েমেনি নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে তিন হাজার ৭৪২ শিশু ও দুই হাজার ৩৬৪ জন নারী। এ ছাড়াও আহত হয়েছে ২৬ হাজার ৭৯ জন বেসামরিক ইয়েমেনি। আহতদের প্রায় চার হাজার হল শিশু ও দুই হাজার ৭৪২ জন নারী।
সৌদি জোটের নির্বিচার বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে ইয়েমেনের প্রায় ৮০ শতাংশ জরুরি বেসামরিক অবকাঠামো যার মধ্যে রয়েছে সড়ক, কোনো কোনো বিমানবন্দর, আবাসিক বাড়ী-ঘর, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, কল-কারখানা, খাদ্য-গুদাম, বাজার, মসজিদ, বিদ্যুৎ ও পানি-সরবরাহ কেন্দ্রের মত জরুরি নানা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। আগ্রাসন ও অবরোধের শিকার ইয়েমেনে দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষ, মহামারি, ক্ষুধা ও অপুষ্টির মত নানা প্রাণঘাতী সংকট।
জাতিসংঘসহ নানা সংস্থার হিসাবমতে প্রায় প্রতি মিনিটে মারা যাচ্ছে অপুষ্টি ও কলেরা রোগসহ নানা রোগের শিকার একটি করে শিশু। বাড়ি-ঘরহারা আশ্রয়হীন শরণার্থীর সংখ্যাও হবে অন্তত অর্ধ-কোটি। অন্যায়-অবরোধের শিকার দরিদ্র এই দেশটির প্রায় অর্ধেকেরও বেশি মানুষ নিয়মিত খাদ্য ও জরুরি ওষুধ পাচ্ছে না।
ত্রিশ লাখেরও বেশি ইয়েমেনি শিশু স্কুল ও পড়াশুনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে অব্যাহত সৌদি আগ্রাসনের কারণে।
ইয়েমেনে সৌদি আরবের আগ্রাসনে সর্বাত্মক মদদ যোগাচ্ছে দখলদার ইহুদিবাদীইসরাইল,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন।সৌদি আরবকে সামরিক, লজিস্টিক, রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা তথ্যসহ সর্বাত্মক সমর্থন, সাহায্য ও সহযোগিতা করছে নব্য-উপনিবেশবাদী এই সরকারগুলো। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন আগ্রাসী জোটের পক্ষে প্রত্যক্ষভাবেও অংশগ্রহণ করছে।
কিন্তু এত কিছুর পরও ইয়েমেনে কোনো লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট। কারণ ইয়েমেনের রাজধানী সানাসহ দেশটির উত্তরাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে আনসারুল্লাহ'র নেতৃত্বাধীন জাতীয় মুক্তি মোর্চার সরকার। অথচ সৌদি জোট ভেবেছিল যুদ্ধ শুরু করার কয়েক মাসের মধ্যেই তারা ইয়েমেনে তাদের পছন্দের পুতুল সরকার বসাতে সক্ষম হবে।

বিপ্লবী ইয়েমেনিরা সৌদি-মার্কিন-ইঙ্গ-ইসরাইলী-আমিরাতি আধিপত্যের কাছে নতজানু এবং ইঙ্গ-মার্কিন-সৌদি-ইসরাইলী অবৈধ স্বার্থ সংরক্ষণকারী বিশ্বাসঘাতক প্রেসিডেন্ট আব্দু রব্বিহ মানসুর আল হাদিকে গণ আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করলে ইয়েমেনে ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরাইলী-সৌদি-আমিরাতি আগ্রাসন শুরু হয়।
জনসমর্থনহীন প্রেসিডেন্ট হাদি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামকা-ওয়াস্তের বা প্রহসনমূলক নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন।কারণ ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী আর কোন পদপ্রার্থী ছিল না। পদত্যাগের পরে মানসুর আলহাদি সৌদি আরবে পালিয়ে যান। যদি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের মতো তার জনসমর্থন থাকত তাহলে আনসারুল্লাহ কি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারত?
শিয়া হুথি আন্দোলন ও বিপ্লবী ইয়েমেন সরকারের বিপুল জনপ্রিয়তার অন্যতম বড় কারণ হল তারা মার্কিন, সৌদি ও ইসরাইলি আধিপত্যসহ বিজাতীয় আধিপত্যের কঠোর বিরোধী।
ইয়েমেনে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে সৌদি সরকারের এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২৩ হাজার কোটি ডলার! দেশটি শিকার হয়েছে ঘাটতি বাজেটের। ফলে দেশটিতে কৃচ্ছতার নীতির আওতায় জনগণের ওপর করারোপ বেড়েছে এবং বেড়েছে তেল-সহ জরুরি নানা পণ্যের দাম।
পশ্চিমা সরকারগুলো মানবাধিকারের বুলি আওড়িয়ে থাকলেও তারা বিশ্বের কোথাও মুসলমানদের ওপর গণহত্যা ঠেকানোর কোনো উদ্যোগই নেয় না। ইয়েমেনের জনগণও এর ব্যতিক্রম নয়। এর কারণ ইয়েমেনের প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজ সম্পদ ও দেশটির সংলগ্ন কৌশলগত বাবুল মান্দাব প্রণালীর ওপর রয়েছে তাদের প্রলুব্ধ দৃষ্টি! এ ছাড়াও অস্ত্র ব্যবসা বহাল রাখার জন্য তারা ইয়েমেনে যুদ্ধের আগুন জিইয়ে রাখছে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটকে দিয়ে। সিরিয়া ও ইরাকের মত ইয়েমেনকেও তারা কয়েক টুকরো করতে চায়।
ইয়েমেনিদের প্রতিরোধ হামলায় নিহত হয়েছে সৌদি জোটের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় সেনা-কর্মকর্তাসহ হাজার হাজার সেনা ও তাদের ভাড়াটে অনুচর। ইয়েমেনিদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা সৌদি জোটের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় হয়ে দেখা দিয়েছে। সৌদি জোট চূড়ান্ত পরাজয় ও চরম অসম্মান এড়াতে চাইলে এখনই ইয়েমেনের চোরাবালি থেকে তার বেরিয়ে যাওয়া উচিত বলে সামরিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। এর আগে গত শতকের ৭০,৮০ও ৯০’র দশকেও ইয়েমেনের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে পরাজিত হয়েছিল সৌদি আরব ও মিশরসহ বাইরের শক্তিগুলো।
দুঃখজনক বিষয় হল ইয়েমেন সংকটের ব্যাপারে পশ্চিমা শক্তিগুলো ও তাদের মিত্র শক্তির নিয়ন্ত্রিত প্রচার-মাধ্যম ও সংবাদ সংস্থাগুলো সঠিক তথ্য প্রচার করছে না। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হল মজলুম ইয়েমেনিদের প্রতি সহায়তা ও সমর্থন দেয়ার ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ সরকার, রাজনৈতিক দল, আলেম সমাজ, বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ ও জনগণের উদাসীনতা বা নির্লিপ্ততা এবং জালিম সৌদি জোট ও তাদের মদদদাতাদের প্রতি সমর্থনের হীন মানসিকতা। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রম-বাজার ধরে রাখার জন্য অনেক সরকার অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইয়েমেনের মজলুমদের প্রতি সমর্থন না দিয়ে আগ্রাসী শক্তিগুলোকেই সমর্থন দিচ্ছে। আর এ থেকে আধুনিক যুগের সরকারগুলোর হীন স্বার্থকেন্দ্রিকতা ও বিবেকহীনতাই ফুটে উঠছে। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/১২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।