পশ্চিম এশিয়ায় ইসরাইল-আমিরাত কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রভাব: পর্ব-এক
বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচিত বিষয় হচ্ছে দখলদার ইসরাইলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্ক স্থাপন। মুসলমানদের প্রধান শত্রু ইসরাইলের সঙ্গে আমিরাতের এই সম্পর্কের ফল বা এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে আমিরাতের সম্পর্ক স্থাপনের অন্যতম একটি পরিণতি হচ্ছে অন্য আরব দেশগুলোও একই কাজ করতে উৎসাহী হবে এবং ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে সই করবে। আমিরাত হচ্ছে আরব দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় এবং পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে প্রথম দেশ যে কিনা ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে সই করেছে এবং এরপর তারা ধীরে ধীরে কূটনৈতিক সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যাবে। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর এ পর্যন্ত কেবল মিশর ১৯৭৮ সালে এবং জর্দান ১৯৯৪ সালে ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। আর বর্তমানে তৃতীয় আরব দেশ হিসেবে আমিরাত শান্তি চুক্তি সইয়ের মাধ্যমে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে যাচ্ছে।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, এ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ শুধু ইসরাইল ও আমিরাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং আরো অনেক আরব দেশ যারা কিনা গত তিন দশক ধরে গোপনে ইসরাইলের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে তারাও এখন প্রকাশ্যে চলে আসবে। বিশেষ করে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর এ অবস্থা আরো জোরদার হয়েছে।
২০১৬ সালের মে মাসে ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলের ওয়েব সাইটে লেখা হয়েছিল, 'বেশ কয়েকটি ধনি আরব দেশের বিপুল অর্থ অবৈধ ইহুদি উপশহর নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।' এ ছাড়া, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরাইল কাতেয প্রথমবার আবুধাবি সফর করে দেশটির কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাতে মিলিত হন। তাই বলা যায়, আমিরাতের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ইসরাইল আসলে পশ্চিম এশিয়ায় রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। তবে বাহরাইন কিংবা ওমানের মতো দেশগুলোও যদি ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয় তবুও তা ফিলিস্তিনিদের অবস্থানে কোনো প্রভাব ফেলবে।
কেউ কেউ মনে করেন, আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ফলে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে দখলদার ইসরাইলের উপস্থিতির সুযোগ তৈরি হবে। কারণ এ অঞ্চলে আমিরাতই হচ্ছে প্রথম দেশ যে কিনা ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ অঞ্চলে ইসরাইলের উপস্থিতির উদ্দেশ্য যতটা না নিরাপত্তাগত তার চাইতে অর্থনৈতিক স্বার্থটাই সবচেয়ে বড়। যদিও অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা বলেই মিশরের সঙ্গে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি এবং জর্দানের সঙ্গে ওয়াদি আরাবিয়া চুক্তি করেছিল ইসরাইল কিন্তু পরবর্তিতে ওই দেশ দুটির সাথে তেলআবিবের নিরাপত্তা বিষয়ক সহযোগিতাও গড়ে ওঠে।
আমেরিকার উপস্থিতিতে আমিরাত ও ইসরাইলের মধ্যে যে শান্তিচুক্তি হয়েছে তা আব্রাহাম চুক্তি নামে পরিচিত। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইল এ অঞ্চলে নিরাপত্তা বিষয়াদিতেও নাক গলানোর সুযোগ পাবে।
ইসরাইল এ অঞ্চলের সব আরব দেশের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় নিরাপত্তা বিষয়েও হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাবে যা কারোরই কাম্য নয়। এমনকি ইরানের ওপরও নজর রাখা সুবিধা হবে ইসরাইলের জন্য। এ কারণে ইরান শুরু থেকেই ইসরাইলের সঙ্গে আমিরাতের শান্তিচুক্তির সমালোচনা করে আসছে। ইরানও সতর্ক থাকায় এবং আমিরাতের এ পদক্ষেপের পরিণতির ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দেয়ায় মনে হয় না শেষ পর্যন্ত ইসরাইল পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে ইরানের পানিসীমার কাছে কোনো সুবিধা করতে পারবে। ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল বাকেরি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হলে প্রতিবেশী আমিরাতের ব্যাপারে ইরানের নীতিতে বিরাট পরিবর্তন আসবে এবং এ অঞ্চলে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কিংবা ইরানের স্বার্থে সামান্য পরিমাণে আঘাত আসলে আমিরাত দায়ী থাকবে এবং ইরান এক মুহূর্তও নীরবে বসে থাকবে না।

ধারণা করা হচ্ছে, ইসরাইলের সাথে আমিরাতের কথাকথিত শান্তিচুক্তির স্বল্পমেয়াদি প্রভাব পড়বে আরব এ দেশটির অভ্যন্তরে। আর সেই প্রভাব হচ্ছে দেশটির শাসন ক্ষমতার ওপর। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক বিশ্লেষক আয়েশ মোহাম্মদ লন্ডন থেকে প্রকাশিত আল কুদস আল আরাবিয়া সাময়িকীতে ইসরাইলের সঙ্গে শান্তিচুক্তির পেছনে আমিরাতের কি স্বার্থ রয়েছে সে সম্পর্কে এক নিবন্ধে লিখেছেন, ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আরব দেশগুলোর মধ্যকার প্রতিযোগিতার কারণ এবং এতে আরবদের কি লাভ তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, দখলদার ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করলেও এতে আরব দেশগুলোর কোনো লাভ হবে না। যৌথ পুঁজি বিনিয়োগ কিংবা যৌথ স্বার্থ রক্ষার যে কথা বলা হচ্ছে তা আসলে সম্পূর্ণ মিথ্যা। তাই যদি হবে তাহলে বহু বছর আগে জর্দান ও মিশর ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করলেও ওই দুটি আরব দেশের আজো কেন উন্নতি হয়নি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনকারী জর্দান ও মিশরের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই শোচনীয় এবং ওই দুটি দেশে পুঁজি বিনিয়োগের অবস্থাও ভালো নয়।
ইসরাইলের সঙ্গে রাজতন্ত্র শাসিত আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্থাপনের মূল কারণ অর্থনৈতিক স্বার্থ নয় বরং রাজনৈতিক। আরব দেশগুলোতে একনায়ক শাসন চলছে। এসব সরকারের প্রতি জনগণের কোনো আস্থা নেই, নেই কোনো গ্রহণযোগ্যতা। সে কারণে জনবিচ্ছিন্ন এই সরকারগুলো নিজেদের অস্তিত্ব ও শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য বাইরের সহযোগিতা নিতে বাধ্য হচ্ছে। সেই সুযোগ নিচ্ছে ইসরাইল ও আমেরিকা। ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন যায়েদের ধারণা আমেরিকা ও ইসরাইলের সমর্থন নিয়ে পশ্চিম এশিয়ো অঞ্চলে নিজের প্রভাব বিস্তার করা যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমিরাত সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিলেও আমেরিকার কাছ থেকে অত্যাধুনিক এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান কেনার তীব্র বিরোধিতা করেছে ইসরাইল যা অনেককেই বিস্মিত করেছে।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমিরাতের সঙ্গে তাদের সমঝোতাকে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের কৌশল হিসেবে দেখছেন। নেতানিয়াহু অভ্যন্তরীণ ব্যাপক রাজনৈতিক চাপের মধ্যে রয়েছেন। আর্থিক সংকট নিরসনে ব্যর্থতা, বেকারত্ব বৃদ্ধি ও দুর্নীতির কারণে প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে তিনি। প্রতি রবিবার হাজার হাজার মানুষ নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে। অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও আসন্ন নির্বাচনে জেতার জন্য কিছু একটাতে সফলতা দেখানোর চেষ্টা করছেন। কারণ তিনিও করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় প্রচণ্ড সমালোচনার সম্মুখীন। এ অবস্থায় আমিরাতের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হহুদিবাদী লবির সমর্থন ধরে রাখার চেষ্টা করছেন যাতে আসন্ন নির্বাচনে জেতা যায়। #
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/