পশ্চিম এশিয়ায় ইসরাইল-আমিরাত কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রভাব: পর্ব-দুই
ইসরাইল ও আমিরাতের মধ্যকার সমঝোতা আব্রাহাম নামে পরিচিত। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এ ধরণের সমঝোতা বা শান্তির উদ্যোগ দখলদার ইসরাইলের মোকাবেলায় ফিলিস্তিনিদের অবস্থানকে দুর্বল করবে। আমিরাতের পররাষ্ট্র নীতিতে ফিলিস্তিনিদের গুরুত্ব কতখানি ছিল এবং ফিলিস্তিনিদের সহায়তায় তারা এ পর্যন্ত কি পদক্ষেপ নিয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ইরানের আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক হোসেন আমির আব্দুল্লাহিয়ান এ ব্যাপারে বলেছেন, আমিরাত আজ পর্যন্ত মজলুম ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ রক্ষায় একটি পদক্ষেপও নেয়নি বরং ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পদক্ষেপ নিয়ে আবুধাবি সরকার ইসরাইলের মোকাবেলায় ফিলিস্তিনিদের অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়েছে। ইসরাইলি জবর দখলের কারণে প্রতিদিনই ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ছোট হয়ে আসছে কিন্তু তারপরও আমিরাত ও সৌদি আরবসহ বেশিরভাগ আরব দেশ নীরব রয়েছে এবং তারা কেবল বিবৃতি ও নিন্দা প্রকাশের মধ্যেই তাদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রেখেছে।
তবে, ইসরাইলের সঙ্গে আমিরাতের শান্তিচুক্তির ফলে ফিলিস্তিনিরা এ মুহূর্তে চাপের মুখে পড়বে ঠিকই কিন্তু তাদের অবস্থান দুর্বল হবে না। কারণ ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগের ফলে পশ্চিম এশিয়ো অঞ্চলে এতোদিন ধরে ঘাপটি মেরে থাকা কিছু আরব সরকারের আসল চেহারা প্রকাশ হতে শুরু করেছে। ইসরাইলের সঙ্গে আপোষকারীদের আসল চেহারা ফিলিস্তিনসহ এ অঞ্চলের সমস্ত প্রতিরোধকামীদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি ফিলিস্তিনের আপোষকামী দলটিও এটা বুঝতে পেরেছে যে, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়া ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষও আমিরাত ও ইসরাইলের সমঝোতাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করে আবুধাবি থেকে রাষ্ট্রদূত ডেকে পাঠিয়েছে।
অন্যদিকে, ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ, লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইরাকের প্রতিরোধ সংগঠনগুলোও ইসরাইল-আমিরাত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা করে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও এক বিবৃতিতে বলেছে, আবুধাবি এ কাজ করে কৌশলগত নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে এবং এর অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে প্রতিরোধ শক্তিশালী হবে। বিবৃতিতে বলা হয়, ইতিহাস বলে দেবে, সংযুক্ত আরব আমিরাত সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ফিলিস্তিনি জাতিসহ গোটা মুসলিম উম্মাহর পিঠে খঞ্জর বসিয়েছে।
লিবিয়া-মার্কিন বাণিজ্য সংস্থার সাবেক নির্বাহী প্রধান জেসন প্যাক 'ফরেন পলিসি' সাময়িকীতে বলেছেন, গত কয়েক শতাব্দি ধরে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের কথা শোনা যাচ্ছিল কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই আরব দেশগুলোই ইসরাইলের সঙ্গে নীরবে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। তাই আমিরাতের সঙ্গে ইসরাইলের যে সমঝোতা হয়েছে তা ওই গোপন সহযোগিতাকেই প্রকাশ্যে এনে দিয়েছে মাত্র। এই সমঝোতা ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে কোনো ভূমিকা রাখবে না বরং সমগ্র এ অঞ্চলে এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ পরিস্থিতি আরব বসন্ত শুরুর পর এ অঞ্চলে নতুন করে সংকটের জন্ম দেবে।
ইসরাইল ও আমিরাতের এই চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে আরবরা কোনো কিছু অর্জন ছাড়াই ইসরাইলকে বিরাট ছাড় দিল। অতীতে জর্দান ও মিশরের সঙ্গে ইসরাইলের যে শান্তি চুক্তি হয়েছিল তাতে তেলআবিব অন্তত দখলিকৃত ভূখণ্ডের বিরাট এলাকা থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এবার ইসরাইল অবশিষ্ট আরব ভূখণ্ড ছেড়ে দেয়া কিংবা মুসলমানদেরকে কোনো বিষয়ে ছাড় দেয়ার ব্যাপারে কোনো প্রতিশ্রুতি না দিয়েই আমিরাতের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করেছে যা তেলআবিবের জন্য বিরাট বিজয়। যদিও আমিরাত দাবি করেছে, জর্দান নদীর পশ্চিম তীরকে ইসরাইলের সঙ্গে একীভূত না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তেলআবিব। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী সাথে সাথে বলেছেন, ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে এবং তা বাদ দেয়া হয়নি।
এ অবস্থায় বাহরাইন ও আমিরাতও যদি কাতারের নীতি অনুসরণ করে তাহলে বলা যায়, 'ভূমির বিনিময়ে শান্তি'র নীতি থেকে সরে এসে ইসরাইল 'শান্তির বিনিময়ে শান্তি' নীতি গ্রহণ করেছে। যার অর্থ দাঁড়াবে আরব দেশগুলো এ ধরনের শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার ফলে কেবল নিজেদের ভৌগোলিক সীমানাকেই দিন দিন ছোট করে ফেলবে এবং ইসরাইলের অপরাধযজ্ঞের প্রতি সমর্থন দেয়া অব্যাহত রাখবে।
ইসরাইলের সঙ্গে আমিরাতের শান্তি চুক্তির আরেকটি খারাপ দিক হচ্ছে, এর ফলে আমিরাত আরো বেশি কলঙ্কিত হয়ে পড়বে যা ভবিষ্যতে ওই দেশটির জন্যই হুমকি ও অমঙ্গল ডেকে আনবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমিরাত প্রতিবেশী দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে লিবিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া ও মিশরের কথা উল্লেখ করা যায়। ওইসব দেশে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে আবুধাবি আজ পর্যন্ত কিছুই অর্জন করতে পারেনি বরং তুরস্ক ও ইরানের মতো শক্তিশালী আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে। কাতারের সঙ্গেও গোলযোগ বাধিয়ে রেখেছে আমিরাত। সম্প্রতি তুরস্কের সঙ্গেও আমিরাতের সম্পর্কে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। আমিরাত এখনো ইরান ও কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়নি অথচ আবুধাবিতে দখলদার ইসরাইলের দূতাবাস খোলার আয়োজন সম্পন্ন করেছে যা কিনা ফিলিস্তিনিদের স্বার্থের পরিপন্থী। এমনকি আমিরাত ইসলামি ও আরবদের পরিচিতি রক্ষার বিষয়টিকেও আমলে নেয়নি।
ইরানের সংসদ স্পিকারের বিশেষ সহকারী ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক হোসেন আমির আব্দুল্লাহিয়ান বলেছেন, আমিরাত পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে ইসরাইলের প্রবেশের সুযোগ করে দিয়ে চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ক্ষেত্রে লালসীমা অতিক্রম করেছে। এখন থেকে এ অঞ্চলে যাই ঘটুক না কেন তার দায়দায়িত্ব ইসরাইল ও আমিরাতকে নিতে হবে।
গত কয়েক দশকে পারস্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ ও আরব লীগ কার্যত কুচক্রী মহলের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। পশ্চিম এশিয়ায় ব্যাপক নিরাপত্তাহীনতা ও সংঘাত ছড়িয়ে পড়লেও তা নিয়ন্ত্রণে এ দুই আরব জোট কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি। বরং তারা সৌদি আরব ও তার পাশ্চাত্যের মিত্রদের স্বার্থই রক্ষা করে চলেছে যার থেকে দখলদার ইসরাইলও সুবিধা নিচ্ছে। তাই আমিরাতের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্থাপনের ফলে ওই দুই আরব জোটের অক্ষমতার বিষয়টি আরো বেশি প্রমাণিত হবে।
ফিলিস্তিন হচ্ছে একটি আরব দেশ ও আরব লীগের সদস্য এবং ইহুদিবাদীরা দশকের পর দশক ধরে তাদের ওপর আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও রাজতন্ত্র শাসিত আরব সরকারগুলো এ বিষয়টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলেছে। # (শেষ পর্ব)
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন