ডিসেম্বর ২৩, ২০২১ ১৯:৩৬ Asia/Dhaka
  • আফগানিস্তানে দরিদ্রতার সুনামি ঠেকাতে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেষ্টা অব্যাহত

গত ১৫ আগস্ট তালেবান আবারো আফগানিস্তানের ক্ষমতা নেয়ার পর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক উদ্বেগ উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছিল। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে এবারও তালেবানের শাসনকালে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তা নিয়েই মূলত সবার মধ্যে উদ্বেগ বিরাজ করছে। এ কারণে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি উন্নয়নের লক্ষ্যে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে বেশ কিছু বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করব। আশা করি আপনাদের সঙ্গ পাব।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আফগানিস্তানের যেকোনো পরিস্থিতিতে অন্য সব দেশের  চাইতে প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপরই সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে এবং এ অঞ্চলের দেশগুলোকেই তা মোকাবেলা করতে হয়। এ  কারণে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর সেদেশের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোকে নিয়ে এ পর্যন্ত বেশ ক'বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। একটি বৈঠক হয় ইরানে এবং অপর বৈঠক হয় পাকিস্তানে। পাকিস্তানের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে প্রথম অনলাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে চীন, ইরান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিরা আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তাদের নিজস্ব প্রস্তাব ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন।

এরপর আফগানিস্তানের প্রতিবেশীদেরকে নিয়ে ফের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে। ওই বৈঠকে কেবল চীন ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অনলাইনে যুক্ত হয়েছিলেন। তেহরানে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে ১১টি ধারা সম্বলিত প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং এতে আফগান সংকট সমাধানের জন্য অংশগ্রহণমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার ওপর সব দেশ জোর দেয়।

তেহরান  বৈঠকে প্রকাশিত বিবৃতে অবিলম্বে আফগানিস্তানে মানবিক সংকট রোধ এবং নতুন করে শরণার্থীর ঢল ঠেকানোর লক্ষ্যে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য জরুরি পণ্য সামগ্রী পাঠানোর জন্য আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়া, আফগানিস্তানে সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, সরকারি অফিস ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা, জনগণের প্রাথমিক প্রয়োজন মেটানো ও তাদের দুঃখ দুর্দশা লাঘবে পদক্ষেপ নেয়া, নারী ও শিশুসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা করার জন্য তালেবানের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

আফগানিস্তানের প্রতিবেশীদের নিয়ে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল গত ৮ সেপ্টেম্বর ইসলামাবাদে এবং দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল গত ২৮ অক্টোবর তেহরানে। যেহেতু তালেবানকে এখনো বিশ্বের কোনো দেশ স্বীকৃতি দেয়নি সে কারণে ওই দুই বৈঠকে তালেবানের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিল না।

আফগানিস্তানের প্রতিবেশীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ওই দুই বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা অংশগ্রহণমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য তালেবানের প্রতি আহ্বান জানান। এরই অংশ হিসেবে তারা আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে সব দল ও জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করারও আহ্বান জানান। তবে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর প্রথম দিকে সব দল ও জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত তারা এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অথচ এটা আন্তর্জাতিক সমাজের অভিন্ন দাবি। আর্থ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত কারণে প্রতিবেশী দেশগুলো আফগানিস্তানের প্রতিটি ঘটনাবলীর ওপর সূক্ষ্ম নজর রাখছে এবং তারা চায় আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তালেবানের মতো কট্টরপন্থীদের একক কর্তৃত্ব যেন না থাকে এবং শাসনকার্যে যেন সবার অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়।

আফগানিস্তানের পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং দেশটির সার্বিক উন্নতিতে সহায়তা করার জন্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বৈঠক অব্যাহত রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে কিছুদিন আগে ভারত সরকারও এ অঞ্চলের সাতটি দেশের জাতীয় নিরাপত্তা সচিব ও উপদেষ্টাদের বৈঠকের আয়োজন করেছিল। বৈঠকে উপস্থিত প্রতিনিধিরাও আফগানিস্তানে সবাইকে নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক সরকার গঠনের ওপর জোর দেন। তারা এক বিবৃতিতে বলেন, আফগানিস্তানের মাটিকে কিছুতেই সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হতে দেয়া ঠিক হবে না।

এ ছাড়া, আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সহযোগিতা করার লক্ষ্যে গত ১৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বৈঠকে তারা আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করা এবং মানবিক সাহায্য দেয়ার লক্ষ্যে একটি তহবিল গঠনের বিষয়ে একমত হন। বিশেষ করে চলমান শীত মৌসুমে লাখ লাখ মানুষ যাতে ক্ষুধা ও দুর্ভোগের শিকার না হয় সেজন্য তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। 

আফগানিস্তানে জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি দফতরের প্রধান ম্যারি অ্যালেন ম্যাক গ্রাওয়ার্তি বলেছেন, বর্তমানে সেদেশে যে দ্রুত গতিতে মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে গত ২০ বছরে এমনটি  দেখা যায়নি। বিশেষ করে খরা এবং সাম্প্রতিক সহিংস ও স্বাশরুদ্ধকর পরিস্থিতির কারণে আফগানিস্তানে ব্যাপক দরিদ্রতার সুনামির আশংকা দেখা দিয়েছে।

ইসলামাবাদে ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে প্রকাশিত বিবৃতিতে অর্থনৈতিক ধ্বস ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান বিশেষ করে আমেরিকায় আটকে পড়া কোটি কোটি ডলার আফগানিস্তানকে ফিরিয়ে দেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে যাতে মানবিক বিপর্যয় থেকে যুদ্ধ বিধ্বস্ত এ দেশটিকে রক্ষা করা যায়। ওআইসি সম্মেলনে উপস্থিত আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলভি আমির খান মোত্তাকি তালেবান ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে আমেরিকার ওপর চাপ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

ইসলামাবাদে ওআইসি সম্মেলন এমন সময় অনুষ্ঠিত হল যখন সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তালেবান আন্তর্জাতিক সমাজের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ব্যাপক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ওআইসি সম্মেলন তাদের জন্য সুযোগ এনে দিয়েছে। তালেবান কর্মকর্তারা বহুবার তাদেরকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কিন্তু  বিশ্বের কোনো দেশই এখন পর্যন্ত তাদেরকে স্বীকৃতি দেয়নি।

এর আগে প্রথমবার আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর তালেবানের উগ্র আচরণের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে সব দেশের। এ ছাড়া আফগানিস্তানে অংশগ্রহণমূলক সরকার গঠন, সামাজিক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখানো, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, নারী সমাজের অধিকার প্রভৃতি ক্ষেত্রে তালেবান এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সমাজের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। এ কারণে তালেবানের প্রতি আন্তর্জাতিক সমাজের সন্দেহ রয়ে গেছে এবং এ অবস্থায় কোনো দেশ তালেবানকে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ