গণহত্যার জনক ও রণ উন্মাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
https://parstoday.ir/bn/news/world-i135168-গণহত্যার_জনক_ও_রণ_উন্মাদ_মার্কিন_যুক্তরাষ্ট্র
১৯৮০ সালে ‘কার্টার ডকট্রেইন’ ঘোষণার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে বিশ্ববাসীকে জানান দেয় যে, দেশটি মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে নিজের ‘গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ’ [অর্থাৎ ফসিল জ্বালানি] রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর।
(last modified 2025-07-29T12:16:04+00:00 )
মার্চ ০৪, ২০২৪ ১১:৫১ Asia/Dhaka
  • গণহত্যার জনক ও রণ উন্মাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

১৯৮০ সালে ‘কার্টার ডকট্রেইন’ ঘোষণার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে বিশ্ববাসীকে জানান দেয় যে, দেশটি মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে নিজের ‘গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ’ [অর্থাৎ ফসিল জ্বালানি] রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর।

বর্তমানেও যখন আমরা আঞ্চলিক বিভিন্ন দেশ ও সংস্থাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য আমেরিকাকে ধ্বংসাত্মক ও অনর্থক বিমান হামলা চালাতে দেখি তখন আমাদের মনে পড়ে যায় যে, আমেরিকার কাছে এখনও তেলের গুরুত্ব মোটেও কমে যায়নি; বরং মার্কিন সরকার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে ধ্বংস করতে তার যুদ্ধ ও বাণিজ্যের মেশিন একসঙ্গে চালু রেখেছে।

এই মুহূর্তে আমরা মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশে আমেরিকার বিমান হামলা প্রত্যক্ষ করছি। আমেরিকার সর্বশেষ বিমান হামলার বিষয়ে আগেই ধারনা করা যাচ্ছিল (এবং তা ছিল অনর্থক)। এই হামলার লক্ষ্য ছিল কারা? লক্ষ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যের সেইসব গোষ্ঠী যাদের তৎপরতায় আমেরিকা নাখোশ! আমেরিকা তাদেরকে এমন শিক্ষা দিতে চায় যাতে তারা আর আমেরিকা নামক পশুর লেজে পা না রাখে। ওয়াশিংটনের হিসাবটি এরকম: “তোমরা আমাদের তিন সেনাকে হত্যা করেছো? তাহলে আমরা তোমাদের শত শত এমনকি হাজার হাজার লোককে হত্যা করব। এসব লোক সামরিক নাকি বেসামরিক সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। হত্যা করে যাব যেহেতু হত্যা করার সামর্থ্য ও শক্তি আমার আছে!”

মানুষ হত্যা করার মতো বিমান শক্তি থাকার কারণে মার্কিন নেতারা বহুবার ওই শক্তি প্রয়োগ করে নিছক মানুষ হত্যা করার বাসনা পূরণ করেছেন। তারা আন্তর্জাতিক আইন, সম্ভাব্য মানবিক পরিস্থিতি কিংবা যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের কথা এক মুহূর্তের জন্যও চিন্তা করতে রাজি নন। তারা সহিংস উপায়ে লক্ষ্যপূরণ করতে চান বলেই বোমাবর্ষণ করে যান।

এই বোমাবর্ষণের আরেকটি উদ্দেশ্য মার্কিন সমরাস্ত্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাঙ্গা রাখা। যুদ্ধ না থাকলে যে এসব প্রতিষ্ঠানের গেটে তালা ঝুলিয়ে দিতে হবে! তবে মার্কিন সমরবিদরা যেখানে ভুল করেন সেখান থেকে শিক্ষা নেন না। তারা হাজার হাজার কিলোমিটার দূর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে এসে বোমাবর্ষণ করেন আমেরিকার শক্তিমত্তা প্রদর্শন করার জন্য। কিন্তু বাস্তবে এতে তাদের দুর্বলতাই প্রকাশ পায়। এ অঞ্চলে তারা পরাজিত হন, পরাজিত হন এবং কেবল পরাজিতই হন। কিন্তু তারপরও আরো বেশি বিমান হামলা বা আরো বেশি ড্রোন হামলা বন্ধ করার নির্দেশ জারি করতে তারা রাজি নন।

একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, আমেরিকার মতো এত বিপুল পরিমাণ বোমা ও যুদ্ধবিমান বিশ্বের আর কোনো দেশে তৈরি হয় না! সেইসঙ্গে যুদ্ধ ও গণহত্যা চালিয়ে ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠার কৌশলেও অন্য কোনো দেশ আমেরিকার সমান পারদর্শী নয়!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী যুদ্ধগুলো বিশ্লেষণ করলে আমেরিকার রণনীতিকে একটি বাক্যে লেখা যাবে, আর তাহলো- “গণহারে মানুষ হত্যা করার জন্য গণহারে অস্ত্র উৎপাদন করা।”

গণহত্যা চালানো কাজে বিশ্বের আর কোনো দেশ আমেরিকার মতো বিশাল অর্থ ও বিমান বাহিনীকে ব্যবহার করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ও জাপানে আমেরিকার বোমাবর্ষণে দিকে তাকালেই এ সত্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে। জাপানে আমেরিকার সর্বশেষ দুই বোমাবর্ষণ ছিল হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে। এছাড়া, ১৯৫০-এর দশকে দুই কোরিয়ার যুদ্ধে উত্তর কোরিয়াকে ধ্বংস করা কিংবা ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ায় আমেরিকার ভয়াবহ বোমা হামলার কথাও ভুলে গেলে চলবে না। ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে একবার ও ২০০৩ সালে দ্বিতীয়বার ইরাকে মার্কিন হামলা এবং ২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের কথাও ইতিহাস মনে রাখবে চিরকাল।

আমরা যখন আমেরিকার এসব অপরাধযজ্ঞ নিয়ে কথা বলছি তখন আরেকটি কথিত দেশ আমেরিকাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে হুবহু একই নীতি অনুসরণ করে যাচ্ছে। ইহুদিবাদী ইসরাইল গাজা উপত্যকাকে পদ্ধতিগতভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছে। দখলদার সেনাদের বোমাবর্ষণ থেকে যেসব ফিলিস্তিনি প্রাণে বেঁচে যাচ্ছেন তারা যাতে আর কোনোদিন এই উপত্যকায় বসবাস করতে না পারেন সেরকম একটি ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করছে ইসরাইল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, গাজা যুদ্ধের শুরুর দিকে ইসরাইলি নেতারা ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ভয়াবহ বিমান হামলা শুরু করার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির ড্রেসডেন শহরে মিত্র বাহিনীর বোমাবর্ষণের কথা উল্লেখ করেছিলেন।

ফিলিস্তিনে ইসরাইলের ভয়াবহ আগ্রাসন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা ও তার ব্রিটিশ মিত্র মিলে জার্মানির বড় শহরগুলোকে একের পর এক বসবাস অযোগ্য করে দিয়েছিল। ওয়াশিংটন ও লন্ডনের যুক্তি ছিল, জার্মানির সকল নাগরিক তাদের নাৎসিবাদী সরকারের সমর্থক বলে তাদের সবাইকে হত্যা করা বৈধ। ইহুদিবাদী ইসরাইল সরকারও আজ গাজা উপত্যকায় একই নীতি অনুসরণ করছে। তেল আবিব দাবি করছে, গাজা উপত্যকার সকল ফিলিস্তিনি হামাসের সদস্য কাজেই তাদের প্রত্যেককে হত্যা করা জায়েয। আর এটি হচ্ছে গণহত্যা চালানোর ইসরাইলীয় (ও আমেরিকান) অপকৌশল। আমেরিকা যেমন যেকোনো বর্বরোচিত হামলাকে ‘গণতন্ত্র রক্ষা’ করার অজুহাত হিসেবে তুলে ধরে তেমনি ইসরাইল প্রতিটি হামলা চালিয়ে দাবি করে তার আত্মরক্ষার স্বার্থে এটি প্রয়োজন ছিল। কাজেই আমেরিকা যে বিমান ও জাহাজ ভরে ভরে ইসরাইলকে সমরাস্ত্র দিয়ে যাচ্ছে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, ইসরাইলও ব্যাপকভাবে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

১১ সেপ্টেম্বরের হামলা এবং এর প্রতিক্রিয়ায় আফগানিস্তান ও ইরাকে ব্যাপকভাবে মার্কিন বোমাবর্ষণের পর ২২ বছর পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এখনও মধ্যপ্রাচ্যে অন্তত ৩০ হাজার সেনা মোতায়েন করে রেখেছে আমেরিকা। কুয়েত ও বাহরাইন থেকে শুরু করে কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত পর্যন্ত দেশগুলোতে এসব মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে। সেইসঙ্গে প্রায় সব সময়ই পারস্য উপসাগরে এক বা একাধিক মার্কিন রণতরী নিজের উপস্থিতি বজায় রাখছে।  সিরিয়া থেকে উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠী দায়েশ নির্মূল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও দেশটির একাংশ দখল করে সেখানে এখন প্রায় ৯০০ মেরিন সেনা মোতায়েন করে রেখেছে ওয়াশিংটন। ঘটনাক্রমে ওই এলাকায় রয়েছে সিরিয়ার সবচেয়ে বড় তেলের খনি। আর ইরাকে মোতায়েন রয়েছে ২,৫০০ মার্কিন সেনা।

মার্কিন সেনা

অন্যদিকে সামরিক সহায়তার আকারে আমেরিকার বিধ্বংসী সব সমরাস্ত্র শুধু ইসরাইলেই যাচ্ছে না সেইসঙ্গে মিশর এবং জর্দানের মতো পদলেহী শাসকদের কাছেও যাচ্ছে। আমেরিকার সরাসরি অস্ত্র সহায়তা পেয়েই সৌদি আরব প্রায় এক দশক ধরে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পেরেছে যদিও সে যুদ্ধে রিয়াদ জয়ী হতে পারেনি। সৌদি আরবের সেই অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা নেয়নি আমেরিকা। এই মুহূর্তে দারিদ্রপীড়িত এই আরব দেশটির বিরুদ্ধে একের পর এক বিমান হামলা চালাচ্ছে মার্কিন বাহিনী। অবশ্য আমেরিকার চাপে গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে গোটা অঞ্চল জুড়ে চলছে কথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ যা যথাসম্ভব বেশি সংখ্যায় মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

মনে রাখতে হবে যে, ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনে প্রায় ১০ লাখ মানুষ নিহত এবং আরো লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।

ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের মধ্যযুগের ক্রুসেড যুদ্ধগুলো যেমন পুরোপুরি ধর্মযুদ্ধ ছিল না তেমনি বর্তমানেও দৃশ্যত, আমেরিকার শত্রুতা শুধুমাত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে নয়। এখনকার যুদ্ধগুলোর মূলে রয়েছে মার্কিন শাসকদের লোভ, প্রতিশোধপরায়ণতা ও অস্ত্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সন্তুষ্টি অর্জন করা।

অবশ্য ১১ই সেপ্টেম্বরের পরবর্তী বছরগুলোর জন্য যে কথাটি প্রযোজ্য ছিল এবং এখনও অনেকাংশে আছে তা হলো- মার্কিনীরা এত ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা চালাচ্ছে নিছক ‘আত্মরক্ষা করার’ জন্য।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ এক সময় বলেছিলেন, আমেরিকা নিছক তার ‘অবাধ স্বাধীনতার’ জন্য বিশ্বব্যাপী এতটা নিন্দিত ও ঘৃণিত। এখানে বলে রাখা ভালো যে, আমেরিকার সংবিধান কিংবা মানবাধিকার ঘোষণায় ‘স্বাধীনতা’ সম্পর্কে যা বলা আছে সেটিই স্বাধীনতা নয়। আমেরিকার স্বাধীনতার অর্থ হলো বিশ্বের নানা প্রান্তে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে যখন তখন যেখানে খুশি সেখানে বোমাবর্ষণ করার স্বাধীনতা। #

পার্সটুডে/এমএমআই/৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।