ডিসকভার ইরান:
পাসারগাদ: পারস্য স্থাপত্যের জননী ও বিশ্বের প্রথম উদ্যান নকশার উৎসভূমি
-
পাসারগাদ: যেখানে প্রতিটি দরজা বলে সাম্রাজ্যের গল্প
ইরানের ফার্স প্রদেশের উত্তরের বিশাল মোরগাব সমতল ভূমিতে নীরব অথচ মহিমান্বিতভাবে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন পাথরের ধ্বংসাবশেষের এক বিস্ময়কর সমাবেশ—যা মানব ইতিহাসে এক বিপ্লবী অধ্যায়ের সাক্ষী।
এটাই পাসারগাদ যা ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মহান কুরুশ বা 'সাইরাস দ্য গ্রেট' প্রতিষ্ঠিত 'হাখামানেশি (আকেমেনিড) সাম্রাজ্যের প্রথম রাজকীয় রাজধানী'। এটি শুধু একটি শহর নয়, বরং বিশ্বের প্রথম 'বহুজাতিক সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক কেন্দ্র, যেখানে ক্ষমতা ও সংস্কৃতির সমন্বয় এক নবজাগরণের সূচনা করেছিল।
সম্রাটের স্বপ্নে গড়া স্থাপত্য
পাসারগাদের সূক্ষ্ম নকশা, সরু স্তম্ভ ও সুনিবিড় উদ্যান শুধু সৌন্দর্যের প্রকাশ নয়; এগুলো ছিল এক নতুন রাজনৈতিক দর্শনের প্রতীক—যেখানে জয় নয়, সহাবস্থান ছিল মূল দর্শন।
এর কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে 'সাইরাসের চিরন্তন সমাধি', যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মরুভূমির হাওয়ায় অবিচল প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। এই সরল অথচ গম্ভীর স্থাপত্য কেবল রাজাধিরাজের বিশ্রামভূমি নয়, বরং এক সভ্যতার জন্মচিহ্ন।
পাসারগাদ ছিল 'পারস্য স্থাপত্যের প্রথম পরীক্ষাগার', যেখানে পরবর্তী পারসেপোলিসের (Persepolis) মহিমা রচিত হয়েছিল। এখানেই প্রথম গড়ে উঠেছিল 'রাজকীয় উদ্যানের ধারণা'—যা পরবর্তীতে “চারবাগ” (Chaharbagh) নকশার রূপ নেয় এবং বিশ্বের উদ্যান স্থাপত্যে বিপ্লব আনে।
পাথরে গাঁথা সৃজনশীলতা ও প্রযুক্তির মেলবন্ধন
'সাইরাস দ্য গ্রেট' তার বিশাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দক্ষ কারিগর ও শিল্পী আনেন—লিডিয়া, আইওনিয়া, ব্যাবিলন, এলাম এবং মিশরের কুশলী স্থপতিরা তাদের নিজস্ব কৌশল নিয়ে হাজির হন পারস্যের পাহাড়ি প্রান্তরে। তাদের দক্ষ হাতে কাদা ও কাঠের স্থাপত্যের পরিবর্তে জন্ম নেয় 'পাথরের নতুন যুগ'—যেখানে নিখুঁতভাবে জোড়া লাগানো বিশাল ব্লক, সূক্ষ্ম খোদাই করা স্তম্ভ ও শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি হয়।
তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা এতটাই উন্নত ছিল যে, আজও স্থপতিরা বিস্মিত হন—বিশেষ করে লোহা ও সিসা-জোড়া ক্ল্যাম্প, আনাথাইরোসিস জয়েন্ট, এবং ভূমিকম্প প্রতিরোধী স্থাপত্যের ব্যবহার পাসারগাদ যুগে অনন্য ছিল।
কিন্তু এখানকার স্থাপত্য কেবল প্রযুক্তিগত নিপুণতা নয়—এটি ছিল এক 'শিল্প-রাজনীতি ও আদর্শের সমন্বয়', যেখানে বিভিন্ন সংস্কৃতি মিলেমিশে গড়ে তুলেছিল এক নতুন সাম্রাজ্যিক নান্দনিকতা।
ইতিহাসের প্রথম 'প্রতীকী প্রবেশদ্বার'
পাসারগাদের 'গেট আর' (Gate R) বা প্রোপাইলিয়াম ছিল ইতিহাসের প্রথম 'প্রতীকী প্রবেশদ্বার'—যেখানে প্রবেশদ্বার আর প্রতিরক্ষা দেয়াল ছিল আলাদা। এর দরজার পাশে ছিল বিশাল ডানাওয়ালা মানবমুখী ষাঁড়ের ভাস্কর্য—আসিরীয় লামাসুর অনুকরণে তৈরি, তবে উদ্দেশ্যে ভিন্ন: এগুলো ছিল নতুন পারস্য সাম্রাজ্যের রক্ষাকবচের প্রতীক।
একটি অনন্য খোদাই এখনও টিকে আছে—তিন মিটার উঁচু 'ডানাওয়ালা মানবমূর্তি', যার মাথায় মিশরীয় ধাঁচের মুকুট, গায়ে এলামীয় পোশাক, আর সাজে আইওনীয় ফুলেল নকশা। এটি একক কোনো সংস্কৃতির নয়; বরং পারস্য সাম্রাজ্যের বহুজাতিক ঐক্যের প্রতীক।
রাজ-উদ্যান: স্বর্গের নকশা
পাসারগাদের সবচেয়ে বড় অবদান স্থাপত্য নয়, বরং 'উদ্যান পরিকল্পনা'। এখানেই জন্ম নেয় 'চাহারবাগ' বা চারভাগে বিভক্ত রাজ-উদ্যানের ধারণা—যা বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম।
পুরাতাত্ত্বিকরা পাথরের তৈরি জলনালা ও জলাধারের নিখুঁত নকশা খুঁজে পেয়েছেন, যা দুটি আয়তাকার বাগানকে চার সমান ভাগে ভাগ করেছে।
রাজা সাইরাসের সিংহাসন ছিল এমনভাবে স্থাপিত যে তিনি বসেই দেখতে পেতেন পুরো উদ্যানের কেন্দ্রীয় অক্ষ—প্রকৃতির সৌন্দর্য ও মানব পরিকল্পনার এক আশ্চর্য মেলবন্ধন।
'পারাদাইস' শব্দটির উৎস পারস্যের 'প্যারিদায়েজা', যার অর্থ 'ঘেরা বাগান'। এই ধারণাই পরবর্তীকালে ইসলামী উদ্যান নকশা থেকে শুরু করে ইউরোপীয় বাগান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, এবং ইরানের এক অমর সাংস্কৃতিক অবদান হিসেবে টিকে আছে।
স্থাপত্যে বহুত্বের আদর্শ
পাসারগাদে ছিল এমন এক সাম্রাজ্যের প্রতীক, যা দখলদারিত্ব নয়, 'সংস্কৃতির সংমিশ্রণ'-এ বিশ্বাস করত। সাইরাস দ্য গ্রেটের শাসনে গড়ে ওঠা হাখামানেশি সাম্রাজ্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে সিন্ধু নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল—একটি সচেতনভাবে বহুজাতিক রাষ্ট্র, যেখানে বৈচিত্র্যই ছিল শক্তি।
এই দর্শনইপাসারগাদর প্রতিটি স্তম্ভ, প্রাঙ্গণ ও অলংকরণে ফুটে উঠেছে। তাই ইউনেস্কোপাসারগাদকে ঘোষণা করেছে 'বিশ্ব ঐতিহ্যের অমূল্য নিদর্শন' হিসেবে—পারস্য শিল্প ও স্থাপত্যের জন্মস্থল হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
অমলিন ঐতিহ্যের প্রাণস্পর্শ
আজও মোরগাব সমভূমির বাতাসে, পাহাড়ের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে পাসারগাদর সেই ধ্বংসাবশেষ—যা কোনো আধুনিক পুনর্গঠনের ছোঁয়া পায়নি।
এখানে দর্শনার্থীরা আজও অনুভব করতে পারেন সাইরাসের সেই পৃথিবী—যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে প্রথম এক 'মানবিক সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন'।
পাসারগাদে কেবল ইরানের সম্পদ নয়; এটি মানবজাতির ইতিহাসে 'সম্মান, সহাবস্থান ও ঐক্যের এক প্রতীক। পাথরে খোদাই করা এই রাজধর্ম আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শক্তি কখনো ধ্বংসে নয়, বরং 'বৈচিত্র্যের ঐক্যে' নিহিত।#
পার্সটুডে/এমএআর/২২