বিশ্বের সবচেয়ে বড় শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ আরবাইন সম্পর্কে আমরা কতটা জানি?
https://parstoday.ir/bn/news/world-i151138
পার্স টুডে - এ পৃথিবীতে যেখানে বেশিরভাগ খবরই উত্তেজনা ও যুদ্ধ নিয়ে সেখানে প্রতি বছর এমন একটি অনুষ্ঠান হয় যা সারা বিশ্ব থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষকে একত্রিত করে, প্রতিবাদ করার জন্য নয়, শক্তি প্রদর্শনের জন্য নয়, বরং একটি মানবিক সত্যকে স্মরণ করতে, আর সে সত্যটি হল: নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। আর এই মহতী অনুষ্ঠানই হল "আরবাইন"।
(last modified 2025-08-14T12:02:42+00:00 )
আগস্ট ১৩, ২০২৫ ১৫:৪৬ Asia/Dhaka
  • বিশ্বের সবচেয়ে বড় শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ আরবাইন সম্পর্কে আমরা কতটা জানি?
    বিশ্বের সবচেয়ে বড় শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ আরবাইন সম্পর্কে আমরা কতটা জানি?

পার্স টুডে - এ পৃথিবীতে যেখানে বেশিরভাগ খবরই উত্তেজনা ও যুদ্ধ নিয়ে সেখানে প্রতি বছর এমন একটি অনুষ্ঠান হয় যা সারা বিশ্ব থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষকে একত্রিত করে, প্রতিবাদ করার জন্য নয়, শক্তি প্রদর্শনের জন্য নয়, বরং একটি মানবিক সত্যকে স্মরণ করতে, আর সে সত্যটি হল: নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। আর এই মহতী অনুষ্ঠানই হল "আরবাইন"।

বিশ্বজুড়ে অনেক ধর্মীয় অনুষ্ঠান বিশেষ কিছু অনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে হয় উদযাপিত। কিন্তু আরবাইন আন্তরিকতা, সহমর্মিতা, প্রেম ও ত্যাগের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে আধ্যাত্মিকতার এক অনন্য রূপ তুলে ধরে। এ অনুষ্ঠান কেবল মহানবী (সা)'র পবিত্র আহলে বাইত (আ.)-এর অনুসারীদের জন্যই নয়, একইসঙ্গে প্রত্যেক স্বাধীন মানুষের জন্য ন্যায়বিচার ও সত্যকে নিয়ে ভাবনার একটি সুযোগ এনে দেয়। 

এই মহাসমাবেশ সম্পর্কে পরিচিতিমূলক কিছু গুরুত্বপূর্ণ ত ও ব্যাখ্যা এখানে তুলে ধরছি:

আরবাইন অর্থ  

আরবাইনের আক্ষরিক অর্থ "চল্লিশ" এবং ইসলামী পরিভাষায় এটি কারবালার ঘটনায় ইসলামের মহানবীর (সা) দৌহিত্র হযরত  ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পরের চল্লিশতম দিন বা চেহলাম  অনুষ্ঠান পালন করাকে বোঝায়। এই দিনটি হিজরি তথা চন্দ্র-বছরের ক্যালেন্ডারে সফর মাসের ২০ তারিখ এবং শিয়া মুসলমানদের কাছে এটি আনুগত্য, শোক প্রকাশ এবং ইমাম হুসাইনের মানবিক আদর্শের পথে অবিচল থাকার অঙ্গীকার নবায়নের প্রতীক। কিন্তু আরবাইন কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। দিনটি ধীরে ধীরে বিশ্বের বৃহত্তম শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় পরিণত হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন ভাষা, বর্ণ ও ধর্মের দুই কোটিরও বেশি মানুষ ইমাম হুসাইনের মাজারে পৌঁছার জন্য ইরাকের কারবালা শহরের দিকে অগ্রসর হন।
 

ইরাকের কারবালায় ইমাম হুসাইনের পবিত্র মাজার ও এর সামনে বাইনুল হারামাইন নামক স্থান

 

কারবালার ঘটনা 

কারবালার ঘটনা আরবাইন বুঝতে হলে কারবালার ঘটনা বুঝতে হবে। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে, ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর পরিবার ও একদল সঙ্গীকে নিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ও অত্যাচারী উমাইয়া সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তিনি তৎকালীন কথিত খলিফা ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে অস্বীকৃতি জানান এবং ফলস্বরূপ তিনি কারবালার প্রান্তরে অবরুদ্ধ হন। আশুরার দিনে তিনি ও তাঁর ৭২ জন সঙ্গী যার মধ্যে তাঁর ছয় মাস বয়সী শিশুও ছিল, শহীদ হন। এই ঘটনা কেবল মুসলমানদের জন্য নয়, একইসঙ্গে প্রতিটি মুক্ত মানুষের জন্য নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, সত্যের প্রতি আনুগত্য এবং মানবিক মূল্যবোধের জন্য ত্যাগের প্রতীক। তাই আরবাইন কেবল একটি ধর্মীয় সমাবেশ ও অনুষ্ঠান নয়, এটি মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধেরও প্রকাশ। 

আরবাইনের পদযাত্রা

 

আরবাইনের পদযাত্রা 

আরবাইন মার্চ কল্পনা করুন, ইরাক এবং অন্যান্য দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ মাইলের পর মাইল হেঁটে কারবালায় পৌঁছাচ্ছেন। ইরাকের আরেকটি পবিত্র শহর নাজাফ থেকে কেউ কেউ তিন দিনে ৮০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কারবালায় পৌঁছান। পথিমধ্যে, স্থানীয়রা রাস্তার ধারে হাজার হাজার সহায়তা কেন্দ্র বা পরিসেবা স্টেশন স্থাপন করেছে , যেখানে বিনামূল্যে খাবার, পানি, বিশ্রামের জায়গা, চিকিৎসা পরিসেবা এবং এমনকি ম্যাসাজও দেওয়া হয়; সবকিছুই আন্তরিকভাবে করা হয় কোনও আর্থিক প্রত্যাশা ছাড়াই। এই পদযাত্রা সহমর্মিতা, ত্যাগ এবং মানবিক ঐক্যের এক গভীর অভিজ্ঞতা। জাতীয়তা, ধর্ম বা ভাষা নির্বিশেষে অংশগ্রহণকারীরা পাশাপাশি হাঁটেন, প্রার্থনা করেন, একসাথে খান এবং কারবালার শহীদদের স্মরণে অশ্রু বিসর্জন করেন। অনেকের কাছে, এই যাত্রা কেবল একটি ধর্মীয় যাত্রা বা জিয়ারত নয়,  একই সঙ্গে তা আধ্যাত্মিক সংস্কার বা পুনর্গঠনও বটে।

বাইনুল হারামাইনসহ কারবালায় দুই পবিত্র মাজার ( মাম হুসাইন-আ ও তাঁর সঙ্গী, সৎ ভাই আবুল ফজলের)

 

 

আরবাইন ও আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, আরবাইন অনুষ্ঠান আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিবিসি, সিএনএন এবং আল জাজিরার মতো নেটওয়ার্কগুলো এই মহাসমাবেশকে নিয়ে প্রতিবেদন করেছে এবং এটিকে "বিশ্বের বৃহত্তম মানব সমাবেশ" বলে অভিহিত করেছে। অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বিপরীতে- যা প্রায়ই নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়, আরবাইন আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপের জন্য এক খোলামেলা পরিবেশ তৈরি করে। এই মহাসমাবেশে অমুসলিমরাও উপস্থিত হচ্ছেন; তাদের মধ্যে কেউ কেউ গবেষক, সাংবাদিক অথবা সমাজকর্মী যারা এই অনন্য বিষয়টি প্রত্যক্ষ করতে এসেছেন। তাদের অনেকেই এই অনন্য পরিবেশে আতিথেয়তা, শৃঙ্খলা এবং আধ্যাত্মিকতার অতি উচ্চ মাত্রা দেখে বিস্মিত হন।

ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের আরবাইন বা চেহলাম সমাবেশে অনেক বিশিষ্ট অমুসলমানও আসেন

 


আরবাইনের বৈশ্বিক বার্তা

যদি আমরা এক বাক্যে আরবাইনের বার্তাকে সংক্ষেপে বর্ণনা করি, তাহলে তা হবে: " মানবতা সীমানা ও ধর্মগুলোর উর্ধ্বে উঠে নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।" কারবালায় ইমাম হুসাইন ক্ষমতার জন্য নয়, বরং সত্যের জন্য লড়াই করেছিলেন। তিনি নিজের ও তাঁর প্রিয়জনদের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়ে এটা দেখিয়ে দেন যে নিপীড়নের মোকাবেলায় নীরবতা মানবতার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। আরবাইন এই বার্তারই স্মারক। লক্ষ-কোটি মানুষ পায়ে হেঁটে, ভালোবাসা ভরা হৃদয় ও অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে কারবালার দিকে যাত্রা করেন যার মাধ্যমে এ কথা তুলে ধরা যায় যে: "আমরা নির্যাতিতদের সঙ্গী, আমরা সত্যের সাথী।"
 

পার্সটুডে/এমএএইচ/১২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।