গাজায় ইউরোপীয় কূটনীতিতে জার্মানি কেন বাধা দিচ্ছে?

পার্সটুডে-ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জার্মানির প্রতি গাজা ইস্যুতে ইইউর অচলাবস্থা ভাঙতে এবং নতুন সমাধান ও ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ইহুদিবাদী শাসনব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান "কায়া কালাস" বলেছেন যে জার্মানির উচিত ব্যবস্থা ও বিকল্প প্রস্তাব দিয়ে গাজা ইস্যুতে ইইউর অচলাবস্থা রোধ করা।

এই বিবৃতিগুলো এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল যখন গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান তীব্রতর হয়েছে এবং মঙ্গলবার স্থল আক্রমণ শুরু হয়েছে। কালাস পূর্বে ইউরোপীয় সংসদে এক ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি ইসরায়েলের প্রতি ইইউর সমর্থন স্থগিত করতে চান এবং ইইউ-ইসরায়েল বাণিজ্য চুক্তির কিছু অংশ সীমিত করতে চান। তবে, বাণিজ্য স্থগিতাদেশ আরোপের জন্য ভোট প্রয়োজন, এবং ইউরোপীয় দেশগুলির নেতা হিসেবে জার্মানি ইসরায়েল বয়কটের বিরোধী বলে জানা যায়।

ইসরায়েলের প্রতি বছরের পর বছর ধরে অবিচল সমর্থনের পর জার্মানির প্রতি ইইউর পররাষ্ট্রনীতি প্রধানের অনুরোধ এমন এক সময়ে এসেছে যখন জনসাধারণের চাপ এবং গাজায় স্থলভাগে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর কারণে ইউরোপ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছে। তবে, বার্লিনের বিরোধিতা এবং সমর্থনের অভাব এই ক্ষেত্রে একটি গুরুতর বাধা।

জার্মানি সর্বদা ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইসরায়েলের অন্যতম বৃহত্তম সমর্থক হিসেবে পরিচিত। ইসরায়েলের প্রতি জার্মানির সমর্থন ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত কারণে নিহিত। রাজনৈতিক স্তরে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে জার্মানি সর্বদা বিশ্বব্যাপী বিষয়গুলিতে এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলকে রক্ষা করে এসেছে। ইসরায়েলের সাথে বার্লিনের ব্যাপক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কও রয়েছে।

জার্মান কোম্পানিগুলো প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা শিল্প, ওষুধ এবং মোটরগাড়ি সহ বিভিন্ন শিল্পে ইসরায়েলের সাথে সহযোগিতা করে। ইহুদিবাদী শাসনব্যবস্থা পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে জার্মানির গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি বাজারগুলির মধ্যে একটি হিসাবেও পরিচিত। অন্যদিকে, জার্মানির ইহুদি লবিগুলিও ইসরায়েলের পক্ষে জার্মান সরকারের নীতি পরিচালনায় প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে।

অতএব, ইসরায়েল বহু বছর ধরে জার্মান সামরিক ও রাজনৈতিক সমর্থন উপভোগ করে আসছে। সরকারের সামরিক শক্তিকে শক্তিশালী করার জন্য ইসরায়েলকে উন্নত অস্ত্র বিক্রি এবং আর্থিক সহায়তা সর্বদা জার্মান সরকারের এজেন্ডায় ছিল। এই সমর্থন, যা জার্মান সরকার সর্বদা ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ হিসেবে ন্যায্যতা প্রমাণ করার চেষ্টা করে আসছে, বাস্তবে ফিলিস্তিনিদের, বিশেষ করে গাজার অসহায় জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অপরাধ অব্যাহত রাখার জন্য কাজ করেছে।

ইসরায়েলের প্রতি জার্মান সমর্থনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারগুলোর মধ্যে একটি হল ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কিত যন্ত্রাংশ এবং সরঞ্জামের মতো উন্নত অস্ত্র সরবরাহ। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, জার্মানি ইসরায়েলে অস্ত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম সরবরাহকারী এবং শাসনব্যবস্থার প্রায় ৩০ শতাংশ অস্ত্র আমদানি জার্মানি থেকে আসে। এই ক্ষেত্রে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বার্লিন ইসরায়েলে ৪৮৫ মিলিয়ন ইউরোরও বেশি অস্ত্র রপ্তানি করেছে।

এই অস্ত্রগুলো ইসরায়েলকে তাদের সামরিক অভিযান তীব্রতর করার এবং ফিলিস্তিনি জনগণকে নির্মমভাবে দমন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ করে দিয়েছে। এই সাহায্য বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে নির্মমভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, বিশেষ করে গাজার সাম্প্রতিক যুদ্ধগুলিতে, যার সাথে ব্যাপক ইসরায়েলি বিমান ও স্থল আক্রমণও ঘটেছে।

জার্মানি ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের অবস্থানে জোর দিয়ে চলেছে, যদিও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিশেষ করে গাজায় নতুন করে ইসরায়েলি আক্রমণ শুরু হওয়ার পর এবং বেসামরিক নাগরিকদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্ন ইইউ দেশের জনসাধারণের চাপের কারণে অনেক ইউরোপীয় রাজনীতিবিদ ইসরায়েলের প্রতি তাদের অতীতের সমর্থনমূলক নীতি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছেন এবং ইসরায়েলি শাসনব্যবস্থার উপর আগ্রাসন বন্ধ করার জন্য আরও বেশি চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন।

ইতিমধ্যে, ইইউর পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কাইয়া কালাস এখন আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছেন যে ইইউ আর একতরফাভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করতে পারবে না এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় চাপকে বাধাগ্রস্ত না করার জন্য জার্মানিকে স্পষ্টভাবে আহ্বান জানিয়েছেন।

এই অনুরোধটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে ইউরোপ আর ফিলিস্তিনের প্রতি বহুত্ববাদী অবস্থান রাখতে পারে না এবং ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধের মুখে নীরব থাকতে পারে না; ইউরোপের জনমত আর ইউরোপের বহুত্ববাদী নীতির প্রতি গ্রহণযোগ্য নয় এবং এই বিষয়ে বাস্তব পদক্ষেপের দাবি করছে। এই প্রসঙ্গে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে ইসরায়েলের অপরাধের নিন্দা করার জন্য এবং এই শাসনব্যবস্থার প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন বন্ধ করার জন্য আরও শক্তিশালী এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জার্মানির এখন অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে সহযোগিতা করার সময় এসেছে, কারণ সমস্ত ইউরোপীয় দেশের অংশগ্রহণ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব নয়।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে জার্মানিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে: হয় ইসরায়েলের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন ত্যাগ করবে এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলির সাথে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেবে, অথবা ইসরায়েলকে সমর্থন অব্যাহত রেখে কেবল তার নিজস্ব বিশ্বাসযোগ্যতাই নয় বরং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবং দেখাবে যে মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের সমর্থনে ইউনিয়নের স্লোগানগুলো খালি স্লোগান ছাড়া আর কিছুই নয়।#

পার্সটুডে/এমবিএ/১৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।