সানায়ে তাকাইচি: জাপানে নারীর ক্ষমতার প্রতীক না পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্তরাধিকারী?
-
সানায়ে তাকাইচি (মাঝে)
পার্সটুডে: জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে 'সানায়ে তাকাইচি'র দায়িত্ব গ্রহণ কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনাই নয়, বরং এমন একটি দেশে যেখানে এখনও পুরুষতান্ত্রিকতার কঠিন দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত, সেখানে ভবিষ্যতের রাজনীতির জন্য একটি পরীক্ষা।
দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাকাইচি একদিকে পরিবর্তনের অঙ্গীকারে, অন্যদিকে ঐতিহ্য রক্ষার দাবিতে আটকে গেছেন; ফলে তাঁর পথচলা হচ্ছে সংস্কারবাদ ও রক্ষণশীলতার মাঝামাঝি এক কঠিন যাত্রা।
গত অক্টোবরে, ইতিহাসের এক সংকটময় সময়ে জাপানের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ৬৪ বছর বয়সী রক্ষণশীল রাজনীতিক সানায়ে তাকাইচিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করে। এই সিদ্ধান্ত আসে এমন সময়ে, যখন গত গ্রীষ্মের নির্বাচনে পরাজয় এবং কোমেইতো পার্টির সাথে ২৬ বছরের জোটের পতন দলটির ক্ষমতার ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছিল।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে'র ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও আদর্শগত উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচিত তাকাইচি দীর্ঘদিন ধরে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি আবের অর্থনৈতিক নীতিকে নতুন নামে 'সানায়ে-নমিক্স' চালিয়ে যাবেন। কিন্তু মূল প্রশ্ন থেকে যায়: কঠোর ও ঐতিহ্যনিষ্ঠ এক নারী কি সংকটে থাকা জাপানকে পরিবর্তনের পথে নেতৃত্ব দিতে পারবেন?
নারীবাদী নয়: পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় টিকে থাকার উপায়
রাজনীতিতে প্রবেশের প্রথম দিন থেকেই তাকাইচি নিজেকে কঠোর ও শৃঙ্খলাপরায়ণ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি মার্গারেট থ্যাচার-কে নিজের রোল মডেল বলেন এবং তাঁর মতোই নীল রঙের স্যুট পরে 'ক্ষমতার প্রতীকী পোশাক'-এর অনুকরণ করেন। যেমন থ্যাচারকে নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে সহকর্মী পুরুষদের থেকেও কঠোর হতে হয়েছিল, তাকাইচিকেও এলডিপির পুরুষশাসিত পরিবেশে একই কৌশল নিতে হয়েছে।
তিনি 'লিঙ্গ কোটা' বা নারীর জন্য নির্দিষ্ট আসনের বিরোধী, বরং 'সমান সুযোগ'-এর পক্ষে কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবে এই অবস্থান তাঁকে নারীবাদী নীতি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তিনি যদিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তাঁর মন্ত্রিসভার অর্ধেক সদস্য নারী হবেন, শেষ পর্যন্ত মাত্র দুইজন নারীকে মন্ত্রী করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পুরুষ রাজনীতিকদের মধ্যে বণ্টন করেন। এই বৈপরীত্য ইঙ্গিত দেয়—দলের স্থিতিশীলতাকে তিনি লিঙ্গ সংস্কারের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে সংঘর্ষে না গিয়ে আপসের পথ বেছে নিয়েছেন।
রক্ষণশীল নারী নেত্রী: পরিবর্তনের নয়, স্থিতির প্রতীক
তাকাইচির মতো নারী নেত্রীর উত্থান কেবল জাপানের ঘটনা নয়। ইউরোপেও যেমন ইতালির জর্জিয়া মেলোনি রক্ষণশীল কাঠামোর মধ্য দিয়েই ক্ষমতায় পৌঁছেছেন। এই নারীরা মূলত সেই ব্যবস্থার 'উৎপাদন', পরিবর্তনের চালক নয়।
তাকাইচির ব্যক্তিগত দিক অবশ্য আলাদা—তিনি হেভি-মেটাল সঙ্গীত পছন্দ করেন ও অবসরে ড্রাম বাজান, যা তাঁকে কিছুটা মানবিক রূপে উপস্থাপন করে। কিন্তু ব্যক্তিগত এই শখ তাঁর রাজনৈতিক কঠোরতাকে নরম করেনি। তিনি এখনো নারীর বিবাহের পর নিজের পারিবারিক নাম রাখার অধিকারের বিরোধিতা করেন—যা জাপানকে উন্নত দেশগুলোর মধ্যেও অস্বাভাবিকভাবে রক্ষণশীল অবস্থানে রেখেছে।
জাপানে নারী রাজনীতিকদের পথ: কাঁচের ছাদ নয়, লোহার প্রাচীর
তাকাইচির অবস্থান বুঝতে হলে জাপানের সামগ্রিক রাজনীতি বিবেচনা করতে হয়—এক সমাজ যেখানে এখনো নারী নেতৃত্বকে ব্যতিক্রম হিসেবে দেখা হয়। টোকিওর গভর্নর ইউরিকো কোইকে নারী ও পরিবারবান্ধব নীতি চালু করে স্থানীয় প্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ দ্বিগুণ করেছিলেন, কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে তাকেও কঠোর প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে। কোইকে নিজেই বলেছিলেন: “জাপানে নারীরা কাঁচের ছাদের নয়, লোহার প্রাচীরের মুখোমুখি।”
অন্য নারী রাজনীতিক রেনহো সাতো'র অভিজ্ঞতাও একই। গণমাধ্যম তাঁর ও কোইকের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে 'নারী ড্রাগনের লড়াই' বলে অভিহিত করেছিল—একটি অবমাননাকর তুলনা যা পুরুষ রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে কখনো করা হয় না। এই বাস্তবতায় তাকাইচি সেই প্রাচীর ভাঙার চেয়ে তার সঙ্গে সহাবস্থান বেছে নিয়েছেন।
তথ্যও এই চিত্রই তুলে ধরে: জাপানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে নারীরা মাত্র ১৫.৭ শতাংশ আসন দখল করে আছেন এবং জি৭ দেশগুলোর মধ্যে লিঙ্গ সমতার সূচকে জাপান সবচেয়ে নিচে। এই দিক থেকে তাকাইচির প্রধানমন্ত্রী হওয়া কোনো মৌলিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত নয়; বরং পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এক বুদ্ধিদীপ্ত অভিযোজন।
এলডিপির সংকট ও নেতৃত্বের পরীক্ষা
তাকাইচির ক্ষমতায় আরোহন ঘটে এমন এক সময়, যখন এলডিপি গভীর সংকটে নিমজ্জিত—নির্বাচনে পরাজয়, দুর্নীতি কেলেঙ্কারি এবং ইউনিফিকেশন চার্চ-এর সঙ্গে কিছু সদস্যের যোগসাজশ ফাঁস হয়ে যাওয়ায় জনবিশ্বাস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। দলকে পুনরুজ্জীবিত করতে তাকাইচি দ্বিমুখী কৌশল নিয়েছেন: একদিকে “আবে-নমিক্স”-এর অর্থনৈতিক ধারা অব্যাহত রাখা, অন্যদিকে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা জোরদার করা।
অর্থনীতিতে তিনি শিথিল নীতি, প্রযুক্তি, সেমিকন্ডাক্টর ও পারমাণবিক শক্তিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাজারে কিছুটা গতি আনতে পেরেছেন। তবে পররাষ্ট্রনীতিতে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতি তাঁর কঠোর অবস্থান উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত তাঁকে জাতীয়তাবাদীদের কাছে জনপ্রিয় করেছে, কিন্তু আঞ্চলিক সম্পর্কে জটিলতা বাড়িয়েছে।
তাকাইচির ভবিষ্যৎ: পরিবর্তন ও ধারাবাহিকতার মাঝখানে
বর্তমানে তাকাইচি এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন, যেখানে জাপান স্থিতিশীল অর্থনীতি, জনআস্থার সংকট ও সামাজিক পরিবর্তনের চাপে দোলাচলে। তিনি প্রথম নারী হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদে পৌঁছেছেন, কিন্তু তাঁর ক্ষমতা এসেছে সংস্কার নয়, বরং প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার সঙ্গে অভিযোজনের মাধ্যমে।
যদি তিনি অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও দুর্নীতি দমন করতে পারেন, তবে হয়তো এলডিপিকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করবেন; কিন্তু নারীদের ও তরুণ প্রজন্মের দাবি উপেক্ষা করলে তাঁর বৈধতা দ্রুত ক্ষয়ে যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত, সানায়ে তাকাইচি হয়তো জাপানে নারীর নতুন যুগের সূচনাকারী নন, বরং সেই পরস্পরবিরোধী বাস্তবতার প্রতীক—যেখানে নারীরা কেবল পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম মেনে চললেই ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারেন। তাঁর সাফল্য বা ব্যর্থতা কেবল এলডিপির ভাগ্য নয়, বরং জাপানে লিঙ্গসমতার ভবিষ্যৎও নির্ধারণ করবে।#
পার্সটুডে/এমএআর/৪