ইসরাইল বিরোধী বিডিএস আন্দোলনে ইউরোপীয়দের যোগদান; প্রকৃত পরিবর্তন নাকি গণচাপ?
-
ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার ঢেউ অব্যাহত রয়েছে
পার্সটুডে-বিশ্বব্যাপী বয়কট, বিচ্ছিন্নতা এবং নিষেধাজ্ঞা আন্দোলন (BDS) আজকাল দ্রুত গতিতে প্রসার লাভ করছে।
ইসরাইলের উপর চাপ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এতে যোগ দিচ্ছে। সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে, নেদারল্যান্ডস ঘোষণা করেছে যে তারা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে অবৈধ ইহুদি বসতিতে উৎপাদিত পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করার জন্য একটি আইন প্রস্তুত করছে।
পার্সটুডে আরও জানিয়েছে, ইসরাইলে উৎপাদিত পণ্য বয়কটের পরিধি সম্প্রসারণ অব্যাহত রয়েছে এবং বিভিন্ন দেশ এই আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে। এ বিষয়ে ডাচ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ভ্যান উইল জোর দিয়ে বলেছেন, দেশটি দখলকৃত অঞ্চলগুলোর সাথে সম্পর্কিত পণ্য আমদানি রোধ করার জন্য একটি আইন প্রস্তুত করছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ফিলিস্তিনের অব্যাহত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাসহ বিশ্বব্যাপী চাপের পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
২০০৫ সালে ১৭০ টিরও বেশি ফিলিস্তিনি নাগরিক সংগঠন কর্তৃক শুরু হওয়া বয়কট, ডিভেস্টমেন্ট অ্যান্ড স্যাঙ্কশনস (বিডিএস) আন্দোলন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রাম দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং এর মূল লক্ষ্য হল ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে বাধ্য করা। এই আন্দোলন ফিলিস্তিনি ভূমি দখল বন্ধ এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানায় এবং ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টির অন্যতম উপায় হিসেবে ইসরাইল-সম্পর্কিত পণ্য ও পরিষেবা বর্জনের পথ বেছে নিয়েছে।
যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে, গাজায় হামলা বৃদ্ধি এবং সহিংসতা বৃদ্ধি এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকার লঙ্ঘনের পর থেকে, আন্দোলনটি আরও বিস্তৃত হয়েছে। বর্তমানে সরকারগুলোও জনগণ এবং জনমুখী প্রতিষ্ঠানগুলির সাথে বিশ্বব্যাপী এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। নেদারল্যান্ডসের সিদ্ধান্তকে ইসরাইলি দখলদারিত্ব নীতি মোকাবেলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, বিশেষ করে এই পরিস্থিতিতে।
কিন্তু নেদারল্যান্ডসের মতো ইউরোপীয় দেশগুলোকে এই আন্দোলনে যোগ দিতে কোন কারণগুলো উদ্বুদ্ধ করেছে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জনসাধারণের চাপ, আইন ও মর্যাদার ঝুঁকি এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন। যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় এবং সাইবারস্পেসে একটি সাধারণ বার্তা পাঠায়, তখন কোনো সরকারই আর উদাসীন থাকতে পারে না। জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া এবং তাদের ভোটার ভিত্তি নিয়ে চিন্তিত রাজনীতিবিদরা তাদের নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। এই ঘটনাগুলো ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশীয় কিছু দেশজুড়ে লক্ষ্য করা যায়।
আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে, দখলদারিত্ব এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ইসরাইলের সাথে সহযোগিতা করা এখন ব্যয়বহুল। আইনি পরিণতি, জনসাধারণের সাহায্য হ্রাস এবং তাদের আন্তর্জাতিক খ্যাতির ক্ষতির ভয়ে সরকারগুলিকে সতর্কতামূলক নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এই পরিবেশে, দখলদারিত্বের সাথে ব্যবসায়িক সহযোগিতা অব্যাহত রাখা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটি বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও ইসরাইলের সাথে সম্পর্কিত পণ্যের বিক্রি হ্রাস এবং ভোক্তাদের ব্যাপক প্রতিবাদের সাথে, দখলদারিত্বের সাথে সহযোগিতা অব্যাহত রাখা কোম্পানি এবং সরকারের পক্ষে আর আকর্ষণীয় নয়। এই নিষেধাজ্ঞা এবং চাপ, বিশেষ করে গাজা যুদ্ধের সময় অধিকৃত অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্যের বিক্রি শতকরা ৩০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। একইসাথে অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে বিদেশী বিনিয়োগও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। কারণ কোম্পানি এবং বিনিয়োগকারীরা তাদের নাম এমন প্রকল্পের সাথে যুক্ত করতে চান না যা জনমতের কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসাবে পরিচিত।
এ ক্ষেত্রে, বিশ্বজুড়ে ছাত্র আন্দোলন, শ্রমিক ইউনিয়ন, শিল্পী এমনকি খুচরা দোকানগুলো তাদের তাক থেকে সন্দেহজনক পণ্য সরিয়ে কোম্পানিগুলোর ওপর সরাসরি অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছে। সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোতে বিশ্বব্যাপী প্রচারণার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষের কণ্ঠস্বর কোম্পানিগুলোর কানে পৌঁছেছে এবং দখলদারদের সাথে যুক্ত অনেক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।
১৯৬৭ সালের অধিকৃত অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য বয়কট কেবল একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নয় বরং এই সিদ্ধান্তটি একটা নিশ্চয়তা যে ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার নিয়ে আলোচনা করা উচিত নয় এবং সামরিক শক্তি আর আর্থিক বিনিয়োগ দিয়ে কেউ সত্য গোপন করতে পারবে না। এই নিষেধাজ্ঞাগুলো একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়, তা হলো: যখন মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, তখন অর্থনৈতিক মুনাফাসহ কিছুই আর ন্যায্যতা দিতে পারে না।
প্রকৃতপক্ষে, ইসরাইলি পণ্য বর্জনের বিশ্বব্যাপী আন্দোলনে নেদারল্যান্ডসের যোগদানের সিদ্ধান্ত কেবল সামাজিক চাপ এবং জনমতের প্রতিক্রিয়া নয় বরং এটিও প্রমাণ করে যে এমনকি ইউরোপীয় দেশগুলোও-যারা একসময় দখলদারদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থক ছিল-তারাও এখন এমন লোকদের চাপের মুখে রয়েছে যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মোকাবেলায় নীরব থাকতে চায় না। নেদারল্যান্ডসের সিদ্ধান্ত একটি বৃহত্তর তরঙ্গের অংশ; একটি তরঙ্গ যা জনগণের স্তর থেকে শুরু হিলেও এখন সরকারী নীতিতে পৌঁছেছে।
পরিশেষে, দখলদার ইসরাইলের সাথে সম্পর্কিত পণ্য বর্জন আন্দোলনে যোগদানের ডাচ সিদ্ধান্ত কেবল জনসাধারণের চাপের প্রতিক্রিয়া নয় বরং অন্যান্য সরকার এবং সংস্থাগুলোর জন্য একটি সতর্কবার্তাও যে অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক উপায়ে দখলদারিত্ব এবং মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘনকে আর সমর্থন করা গ্রহণযোগ্য নয়। এই প্রতীকী এবং ব্যবহারিক পদক্ষেপ এমন একটি বিশ্বের দিকে আরেকটি পদক্ষেপ যারা ইসরাইলের আগ্রাসী নীতির মুখে আর নীরব থাকতে ইচ্ছুক নয়।#
পার্সটুডে/এনএম/১১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।