বাংলাদেশ কি ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে?
-
ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরের কৌশলগত অবস্থানে বাংলাদেশ
পার্সটুডে-বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো যেখানে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরে প্রভাব বৃদ্ধির জন্য প্রতিযোগিতা করছে, বাংলাদেশ সেখানে বঙ্গোপসাগরে তার ভূ-কৌশলগত অবস্থানের ওপর নির্ভর করে, নিরপেক্ষতা, স্থিতিশীলতা এবং ব্যাপক সহযোগিতার ভিত্তিতে "ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দৃষ্টিভঙ্গি"র ওপর নির্ভর করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ খেলোয়াড়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার চেষ্টা করছে।
বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে, বঙ্গোপসাগর আন্তর্জাতিক কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সেইসাথে বাংলাদেশ তার অনন্য ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগকারী হিসেবে বিবেচিত হয়। এই অবস্থান দেশটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন এবং জাপানের মতো শক্তিগুলোর ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত করেছে। পার্সটুডে'র এই প্রতিবেদনে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তন, নিরাপত্তা ও আবহাওয়াগত চ্যালেঞ্জ ইত্যাদিসহ বাংলাদেশের ভবিষ্যত পর্যালোচনা করা হয়েছে:
নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি; ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল
'সকলের সাথে বন্ধুত্ব এবং কারও সাথে শত্রুতা নয়'-এই স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশ, ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার পররাষ্ট্রনীতির কাঠামো তৈরি করেছে। সে অনুযায়ী সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা, রাষ্ট্রীয় সমতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং অন্যান্য দেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতির ওপর ভিত্তি করে নীতি কাঠামো তৈরি করেছে। এই পদ্ধতি নিরাপত্তা ব্লক নামে পরিচিত 'কোয়াড' (জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চতুর্পক্ষীয় সংলাপ) এর বিপরীত,, কেননা এটি প্রায়শই চীন-বিরোধী হিসেবে পরিচিত। ঢাকার লক্ষ্য হল 'মুক্ত, স্বাধীন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক' একটি অঞ্চল তৈরি করা যেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, যৌথ নিরাপত্তা, ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার চেয়ে অগ্রাধিকার পাবে। এই বুদ্ধিমান অবস্থান প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর সাথে যুগপত সহযোগিতার সুযোগ করে দেয়।
সমুদ্র নিরাপত্তা অগ্রাধিকার এবং বিশাল জলবায়ু চ্যালেঞ্জ
বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র রুটের ওপর (বিশ্ব বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ) বিশ্ব অর্থনীতির নির্ভরতার কারণে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হল নৌচলাচলের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক আইন মানা নিশ্চিত করা। তবে, অবৈধ মাছ ধরা, জলদস্যুতা এবং মানব পাচারের মতো জটিল হুমকি এই জলপথের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটিতে পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অনুমান অনুসারে, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দেশটি প্রতি বছর ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হবার আশঙ্কা রয়েছে। এই সংকট বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য সরাসরি হুমকিস্বরূপ।
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং কৌশলগত ধারাবাহিকতা নিয়ে অনিশ্চয়তা
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উন্নয়ন তাদের ভূমিকার ভবিষ্যত নির্মাণের একটি নির্ধারক কারণ। ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। সরকার এখনও 'ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশন' এবং এর পূর্ববর্তী আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে তার অবস্থান প্রকাশ করে নি। এই অস্পষ্টতা ঢাকার ভারসাম্যপূর্ণ এবং নিরপেক্ষ কৌশলের স্থায়িত্ব সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন তোলে এবং দেশের ভবিষ্যত নির্ধারণে বহিরাগত শক্তিগুলোকে দিক-নির্দেশক ভূমিকা ও কৌশল প্রয়োগের সুযোগ তৈরি করতে পারে।
অভ্যন্তরীণ ও বাইরের ভারসাম্য রক্ষায় মধ্যস্থতার ভবিষ্যত
বাংলাদেশ তার অনন্য ভৌগোলিক অবস্থান, বিচিত্র সুবিধা এবং নিরপেক্ষতার একটি স্মার্ট কৌশলের মাধ্যমে, বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি স্থিতিশীল খেলোয়াড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জাপানের মতো শক্তিগুলোর দ্বারা এই ভূমিকার স্বীকৃতি তার গুরুত্বের প্রমাণ। তবে এর সাফল্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর নির্ভর করে: প্রথমত, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়কাল অতিক্রম করা এবং একটি যোগ্য সরকার প্রতিষ্ঠা করা যে সরকার পূর্ববর্তী কৌশল অব্যাহত রাখতে পারে অথবা একটি নতুন সুসঙ্গত সংস্করণ উপস্থাপন করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তার মতো মৌলিক চ্যালেঞ্জগুলো, যেগুলো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব হবে না, একইসাথে সুকৌশলে পরিচালনা করা। এশিয়ার 'যোগাযোগের সেতু' হিসেবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে কিভাবে তারা এই দুটি কঠিন পরীক্ষা মোকাবেলা করবে।#
পার্সটুডে/এনএম/৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।