পেগাসাস পুরো ফোনটির দখলই পেয়ে যায়
পেগাসাস কাণ্ড: ইসরাইল ও বিশ্বের স্বৈরসরকারগুলোর জন্য বড় কেলেঙ্কারি
বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মীসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্মার্টফোনে ইসরাইলের তৈরি হ্যাকিং সফটওয়্যার 'পেগাসাস' ব্যবহার করে আড়িপাতার ঘটনা ফাঁস হয়েছে। এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। প্যারিসভিত্তিক সংবাদ সংস্থা 'ফরবিডেন স্টোরিজ' এবং 'আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন 'অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের' অনুসন্ধানে এ ঘটনা বেরিয়ে আসে।
'ফরবিডেন স্টোরিজ' এবং 'অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল' তাদের অনুসন্ধানে নাম ফাঁস হওয়া ব্যক্তিদের যাদের স্মার্টফোনে আড়িপাতা হয়েছিল তাদের তালিকা ব্রিটেনের গার্ডিয়ান, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট, ভারতের দ্য ওয়্যারসহ বিশ্বের ১০ টি দেশের মোট ১৭টি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে শেয়ার করে। তারা সবাই মিলে এই অনুসন্ধানের নাম দিয়েছে 'পেগাসাস প্রজেক্ট' যাতে ৮০ জনেরও বেশি সাংবাদিক যুক্ত ছিলেন। তাদের দাবি, পেগাসাস নামের স্পাইওয়্যার অ্যাপ যা সাধারণত জঙ্গি কার্যকলাপের উপর নজরদারি চালাতে বা সামরিক গোয়েন্দাদের কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সেই অ্যাপ দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সবার ওপর গোপন নজরদারি চলছিল।
ব্রিটিশ প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, পেগাসাস ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো 'টার্গেট' করে নিজ দেশের বিভিন্ন ব্যক্তিদের উপর নজরদারি চালাচ্ছিল যাদের তারা হুমকি বলে মনে করে। এসব সরকার কোন না কোন সময় নাগরিক অথবা বিরোধী রাজনৈতিক নেতা অথবা সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের উপরে গোপন নজরদারির জন্য অভিযুক্ত হয়েছে।
ইসরাইলি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপ পেগাসাস নামে ওই স্পাইওয়্যারের নির্মাতা সংস্থা এবং এই অ্যাপটিকে মিলিটারি ইনটেলিজেন্সের লাইসেন্সও দিয়েছে ইসরাইল সরকার। এটা দিয়ে আইফোন কিংবা অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ঢুকে ব্যবহারকারীর অজান্তে তার বার্তা, ছবি, ইমেইল পাচার; কল রেকর্ড, মাইক্রোফোন চালু রাখা সম্ভব। এনএসও গ্রুপ যদিও বলছে, অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের উপর নজরদারি চালানো তাদের ওই স্পাইওয়্যার তৈরির লক্ষ্য। কিন্তু গোপনে ব্যবহার করতে বিভিন্ন দেশের সরকার এনএসও-র গ্রাহক হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে, অ্যামনেস্টির সাইবার সিকিউরিটি ল্যাব পরিচালনাকারী ক্লডিও গার্নিয়েরি বলেছেন, 'যদি কোনো স্মার্টফোনে পেগাসাস সফটওয়্যারটি ঢোকানো যায়, তবে এনএসও-র গ্রাহক পুরো ফোনটির দখলই পেয়ে যাবে। ফোনের মালিকের মেসেজ, কল, ছবি, ইমেইল সবই দেখতে পাবে, এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, সিগন্যালের বার্তাগুলোও পড়তে পারবে। গোপনে ক্যামেরা কিংবা মাইক্রোফোন চালুও করতে পারবে। স্মার্টফোন ব্যবহার না করলেও এটি আশপাশ থেকে শব্দ গ্রহণ করতে থাকে।'
'পেগাসাস প্রজেক্ট' বলছে ৫০ হাজারেরও বেশি ফোন নম্বরের তালিকা তাদের অনুসন্ধানে সামনে এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৬ সাল থেকে এনএসও–এর গ্রাহকরা এসব নম্বরে আড়ি পেতেছে। সেখানে অন্তত ৩৭ জন সিনিয়র সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, বিজনেস এক্সিকিউটিভস, সৌদি আরবের খুন হওয়া সাংবাদিক জামাল খাসোগি-র সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দুই নারীর এমন সেলফোন নম্বর রয়েছে যাদের উপর গোপন নজরদারি চালানোর একদম যথাযথ প্রমাণ রয়েছে।
প্রকাশিত তালিকায় বিশ্বের ২১ দেশের ১৮০ জন সাংবাদিককে 'টার্গেট' করার কথা বলা হয়েছে যাদের মধ্যে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস এর মতো বিশ্বখ্যাত পত্রিকার সাংবাদিকরা রয়েছেন। এনএসও গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকার যেমন বাহরাইন, মরক্কো, সৌদি আরব, ভারত, মেক্সিকো, হাঙ্গেরি, আজারবাইজান, টোগো, রুয়ান্ডা।
২০১৯ সালের অক্টোবর মাসেও আলোচনায় এসেছিল পেগাসাস। তখন পেগাসাসের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের অন্তত ১৪০০ ব্যক্তির ফোনে ইসরাইলি প্রযুক্তি দিয়ে আড়ি পাতার অভিযোগ উঠেছিল। রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ শিকার হয়েছেন এই হ্যাকিংয়ের। কীভাবে কাজ করে পেগাসাস স্পাইওয়ার তা নিয়েও চলছে নানা আলোচনা। এটি ইসরাইলি সংস্থা এনএসও-র তৈরি এমন সফটওয়্যার, যা মোবাইলে আড়ি পাতার অস্ত্র হিসেবে কাজ করে। ফোনে কী কথাবার্তা হচ্ছে, হোয়াটসঅ্যাপে কী আদান-প্রদান হচ্ছে সবই জানা যায়। ফোনে কী তথ্য, নথি, ছবি রয়েছে সেটাও দেখে ফেলা যায় এর মাধ্যমে। অথচ যার মোবাইল হ্যাক করা হয়েছে, তিনি জানতেই পারেন না। প্রথমে ফোনে একটি ওয়েবসাইটের লিঙ্ক পাঠানো হয়। তাতে ক্লিক করলেই মোবাইলে পেগাসাস ইনস্টল হয়ে যায়।
ভারতে দু'জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, তিন জন বিরোধী নেতা-নেত্রী, এক জন সাংবিধানিক পদাধিকারী, চল্লিশের বেশি সাংবাদিক, বহু ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি, নিরাপত্তা সংস্থার বর্তমান ও প্রাক্তন প্রধান, সমাজকর্মী, আমলা, আইনজীবীরা আক্রান্ত এই স্পাইওয়্যারে। যদিও মোদী সরকার জানিয়েছে, ব্যক্তি পরিসরের মৌলিক অধিকারের প্রতি সরকার দায়বদ্ধ। নির্দিষ্ট কারও উপরে সরকারি নজরদারির অভিযোগ ভিত্তিহীন।
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান জানিয়েছে, 'নিষ্পেষণমূলক শাসকগোষ্ঠী নিজেদের উদ্দেশে ব্যবহার করছে পেগাসাস, আছে যুবতীর নগ্ন ছবিও। কর্তৃত্ববাদী ও বিশ্বের সবচেয়ে নিষ্পেষণমূলক কিছু শাসকগোষ্ঠী ইসরাইলে তৈরি এই স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে নির্বাচিত অধিকারকর্মী, ভিন্নমতাবলম্বী এবং সাংবাদিকদের গোপনীয় তথ্য চুরি করতে ব্যবহার করেছে। পেগাসাসের উৎপাদনকারী ইসরাইলের এনএসও গ্রুপ বার বার বলেছে, তাদের আবিষ্কৃত পেগাসাস শুধু সন্ত্রাসী ও ভয়াবহ অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু সরকারগুলো তা ব্যবহার করছে এর বাইরে নিজেদের উদ্দেশে।
এরই মধ্যে পেগাসাসের মাধ্যমে বিশ্বের কমপক্ষে ৫০ হাজার মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর ফোনকল, কন্টাক্ট লিস্ট, টেক্সট ম্যাসেজ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আড়ি পাতা হয়েছে। এতে বাদ পড়েনি অনেক দেশের সরকার প্রধান, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীপরিষদের সদস্য, কূটনীতিক, সাংবাদিকসহ ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনীতিকও।
এমন অনেক তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়েছে আজারবাইজানের। সেখানে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় স্বৈরাচার ইলহাম আলিয়েভ। তিনি ভিন্ন মতাবলম্বীদের সহ্য করতে পারেন না বললেই চলে। সেদেশের বিপুল সংখ্যক অধিকারকর্মীর তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়েছে। সৌদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মরোক্ক ইসরাইলের দেয়া পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করছে বহুদিন ধরে। দখলদার ইসরাইলের সাথে ওই চারটি আরব দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা সবারই জানা আছে। ইসরাইল বহু আগে থেকেই বিরোধীদের ওপর গোয়েন্দাবৃত্তির কাজে আরব দেশগুলোকে সহযোগিতা করে আসছে।
সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে ইহুদিবাদী ইসরাইলের কুখ্যাত প্রযুক্তি কোম্পানি এনএসও গ্রুপের কাছ থেকে পেগাসাস স্পাইওয়্যার কেনার জন্য সৌদি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল তেল আবিব। জানা যায়- সৌদি আরব, বাহরাইন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো নিপীড়ক দেশসহ কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর কাছে ইসরাইল পেগাসাস স্পাইওয়্যার বিক্রির পরিকল্পনা নেয় এবং এক্ষেত্রে ইসরাইলের যুদ্ধ মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এইসব কর্তৃত্ববাদী সরকার নিজ নিজ দেশের ভিন্ন মতাবলম্বী, বিরোধী রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী এবং সাংবাদিকদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়েছে এই পেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে। তবে বিশ্বব্যাপী পেগাসাস স্পাইওয়্যার ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ইসরাইলের ওপর এরইমধ্যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে।#
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/