অক্টোবর ০৭, ২০২১ ২০:২৭ Asia/Dhaka
  • ভেনিজুয়েলার পানিসীমায় পৌঁছার পর ইরানি জ্বালানিবাহী জাহাজকে স্কর্ট করে নিয়ে যায় সেদেশের যুদ্ধজাহাজ ও সামরিক হেলিকপ্টার
    ভেনিজুয়েলার পানিসীমায় পৌঁছার পর ইরানি জ্বালানিবাহী জাহাজকে স্কর্ট করে নিয়ে যায় সেদেশের যুদ্ধজাহাজ ও সামরিক হেলিকপ্টার

ড. সোহেল আহম্মেদ: মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভেনিজুয়েলার পর এখন লেবাননে পেট্রোলসহ পরিশোধিত জ্বালানি তেল পাঠাচ্ছে ইরান। ইরানের পদক্ষেপের কারণে ভেনিজুয়েলায় তীব্র জ্বালানি সংকট নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সরকারের পতন ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। লেবাননেও ইরানি জ্বালানি পৌঁছার পর জনরোষ কিছুটা স্তিমিত হয়েছে। প্রাণ ফিরে পাচ্ছে কৃষি ও শিল্প খাত। দুই দেশেরই জ্বালানি সংকটের পেছনে রয়েছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা।

ভেনিজুয়েলায় জ্বালানি সংকট নিরসনে ইরানের ভূমিকা

ভেনিজুয়েলার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সরকারের পতন ঘটাতে দুই দশক ধরে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরির পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে হত্যার চেষ্টা চালাচ্ছে আমেরিকা। সামরিক বাহিনীকেও উসকে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। অবশ্য এরিমধ্যে মার্কিন ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় নিজেকে হুগো চ্যাভেজের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে প্রমাণ করেছেন মাদুরো। এখন নিষেধাজ্ঞাই যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। জ্বালানি খাতে আরোপ করা হয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। রপ্তানিকারক দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ে ভেনিজুয়েলাকে পরিশোধিত জ্বালানি সরবরাহে রাজি হচ্ছিল না। এ পরিস্থিতিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় ইরান।

জ্বালানি তেলের রিজার্ভের দিক থেকে বিশ্বে  প্রথম স্থানে রয়েছে ভেনিজুয়েলা। এরপরও দেশটিকে পেট্রোলসহ পরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করতে হয়। পরিশোধিত জ্বালানি উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানোর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে তা সম্ভব হয়নি। দেশে যেসব তেল শোধনাগার রয়েছে সেগুলোর আধুনিকায়নও করা যায়নি। নতুন যন্ত্রপাতি আমদানিতে বাধা দিয়েছে আমেরিকা। ইরান পরিশোধিত জ্বালানি পাঠানোর পাশাপাশি পরিশোধনের যন্ত্রপাতিও পাঠিয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভেনিজুয়েলা ইরানের সঙ্গে জ্বালানি সহযোগিতা বিষয়ক চুক্তিতে সই করেছে। আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে ভেনিজুয়েলা সহযোগিতার বিনিময়ে ইরানকে স্বর্ণের বার দিয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে।

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ভেনিজুয়েলায় পেট্রোলসহ পরিশোধিত জ্বালানি রপ্তানির সিদ্ধান্ত থেকে ইরানকে বিরত রাখতে ওয়াশিংটন বার বার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু ইরান এসব হুমকিকে পাত্তা দেয়নি বরং বীর দর্পে ভেনিজুয়েলায় জ্বালানি ও শোধনাগারের যন্ত্রপাতি পৌঁছে দিয়েছে। আমেরিকার দোরগোড়ায় আন্তর্জাতিক পানিসীমায় দাপিয়ে বেড়িয়েছে ইরানের বিশাল বিশাল তেলবাহী জাহাজ।  এর মাধ্যমে ইরান সাহসের সঙ্গে মার্কিন একাধিপত্য রুখে দিতে গোটা বিশ্বকে পথ দেখানোর চেষ্টা করেছে।

ইরানের ভূমিকায় পাল্টে যাচ্ছে লেবাননের পরিস্থিতি

২০১৮ সালের মে মাসে লেবাননের সংসদ নির্বাচনে হিজবুল্লাহ অনেক বেশি আসন পাওয়ার পর থেকেই দেশটির বিরুদ্ধে মার্কিন ও ফরাসি ষড়যন্ত্র বাড়তে শুরু করে। আমেরিকা জানায় তারা লেবাননের সরকারে হিজবুল্লাহর অংশগ্রহণের বিরোধী, একে একে নেমে আসে নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞার খড়গ। এরই ধারাবাহিকতায় দুর্বল হয়ে পড়ে দেশটির অর্থনীতি, দেখা দেয় জ্বালানি সংকট। পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ না থাকায় রুটি তৈরির অনেক দোকান বন্ধ হয়ে যায়। হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা সেবায় বিঘ্ন ঘটে। কৃষি ও শিল্প খাতে নেমে আসে স্থবিরতা।

জ্বালানি সংকটের কারণে সব কিছুই যখন অচলাবস্থার সম্মুখীন তখন ইরানের কাছে সহযোগিতা চায় লেবাননের হিজবুল্লাহ। সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ জানান নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইরান থেকে পরিশোধিত জ্বালানি আনা হবে, জ্বালানিবাহী জাহাজে আঘাত করা হলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে বলেও তিনি হুঁশিয়ারি দেন। নাসরুল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেন, ইরান থেকে যেসব জাহাজে করে লেবাননের জন্য জ্বালানি আসবে সেগুলো লেবাননের ভূখণ্ড হিসেবে গণ্য হবে। কেউ যদি তাতে আঘাত হানে তাহলে তা লেবাননের ওপর হামলা বলে বিবেচনা করা হবে। সাগরে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েই ইরান থেকে পরিশোধিত জ্বালানি আমদানির ঘোষণা দেয় হিজবুল্লাহ। সংগঠনটির কার্যনির্বাহী পরিষদের প্রধান সাইয়্যেদ হাশেম সাফিউদ্দিন বলেছেন, তারা নৌযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।

সাইয়্যেদ নাসরুল্লাহর ঘোষণার পর থেকে ইরানের পরিশোধিত জ্বালানিবাহী জাহাজগুলো একের পর এক সিরিয়ার বন্দরে ভিড়ছে এবং সেখান থেকে ট্যাংকারে ভরে ডিজেলসহ পরিশোধিত জ্বালানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে লেবাননে। ইরান জ্বালানি সংকট নিরসনে এগিয়ে আসার পর থেকেই আমেরিকা লেবানন বিরোধী নিষেধাজ্ঞায় ছাড় দিতে শুরু করেছে।   

সংকট যেভাবে সুযোগে পরিণত হলো

প্রায় এক দশক আগেও ইরান বিদেশ থেকে পরিশোধিত জ্বালানি বিশেষকরে পেট্রোল ও ডিজেল আমদানি করত। সে সময় মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ পেট্রোল ও ১১ শতাংশ ডিজেলের জন্য ইরানকে বিদেশের ওপর নির্ভর করতে হতো। দেশটি সস্তায় অপরিশোধিত জ্বালানি বিক্রি করে চড়া মূল্যে পরিশোধিত জ্বালানি কিনে আনত। ইরানের আমদানি নির্ভরতাকে অপব্যবহারের চেষ্টা করে আমেরিকা। পেট্রোল আমদানির ওপর আরোপ করে নিষেধাজ্ঞা। ওয়াশিংটনের ধারণা ছিল পেট্রোল ও ডিজেল আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে ইরানিদের গাড়ি ও কল-কারখানার চাকা বন্ধ হয়ে যাবে, নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী হবে। এরই ধারাবাহিকতায় গণবিক্ষোভে ইসলামী সরকারের পতন ঘটবে বলে তারা স্বপ্ন দেখেছিল। পেট্রোল নিষেধাজ্ঞায় ইরান সত্যিই কাবু হয়ে পড়বে বলে তখন অনেক নিরপেক্ষ বিশ্লেষকও মন্তব্য করেছিলেন।

কিন্তু পেট্রোল আমদানির ওপর এই নিষেধাজ্ঞাও আমেরিকার জন্য বুমেরাং হয়েছে। ইরান দ্রুততম সময়ের মধ্যে জ্বালানি তেল পরিশোধনের সক্ষমতা কয়েক গুণ বাড়িয়েছে। পেট্রোল ও ডিজেল আমদানিকারক দেশ থেকে এখন পরিণত হয়েছে রপ্তানিকারক দেশে। এর ফলে এই খাতে অন্যের ওপর ইরানের নির্ভরতা পুরোপুরি কেটে গেছে। পাশাপাশি প্রতি বছর কোটি কোটি ডলার সাশ্রয় হচ্ছে। পেট্রোল ও ডিজেল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা মার্কিন আধিপত্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে। ইরান ঘোষণা দিয়ে মার্কিন জ্বালানি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মিত্রদের কাছে পেট্রোল ও ডিজেল পৌঁছে দিচ্ছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় এভাবে প্রকাশ্যে আঘাত হানার ঘটনা এর আগে আর ঘটেনি।

আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনে সরাসরি অথবা পরোক্ষভাবে সামরিক যুদ্ধে জড়িয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু কোথাও এখন পর্যন্ত বিজয়ের মালা জোটেনি। আফগানিস্তানে চরম পরাজয়ের কথা তারা নিজেরাই প্রকাশ্যে স্বীকার করছে। সামরিক দিক থেকে আমেরিকা যে ব্যর্থ ও পরাজিত তা এখন সবার কাছে প্রমাণিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা এ ক্ষেত্রে কর্তৃত্বের যে আসনে বসেছিল এখন তা ধসে পড়েছে। এ কারণে দেশটি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ নানা বিকল্প উপায়ে অন্যান্য দেশের ওপর কর্তৃত্ব করার চেষ্টা জোরদার করেছে। কিন্তু ইরান এসব অপচেষ্টা নস্যাতে বার বার মার্কিন দম্ভে আঘাত হেনে অন্যদের পথ দেখাচ্ছে। আশা করা যায় এই পথ আরও প্রশস্ত হবে।#

ড. সোহেল আহম্মেদ: লেখক ও সাংবাদিক

[email protected]

ট্যাগ