ডিসেম্বর ০১, ২০২১ ১৭:৩৭ Asia/Dhaka

শিশু-কিশোরদেরকে বই পাঠের প্রতি আগ্রহী করে তোলার গুরুত্ব ও এ সংক্রান্ত কৌশল সম্পর্কে আমরা কথা বলেছিলাম গত পর্বের আলোচনায়।

বই পড়ার অভ্যাস জীবনের যে কোনো সময়েই খুব জরুরি ও অশেষ কল্যাণকর। তবে শিশু-কিশোরদেরকে যে বই সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে ও তাদেরকে নানা বিষয় শেখানোর জন্য যে মাধ্যম সবচেয়ে বেশি কার্যকর তা হল গল্পেরই বই ও গল্প শোনানো। আজ আমরা এ বিষয়ের গুরুত্ব সম্পর্কেই আলোকপাত করব।

গল্পের মাধ্যমে কোনো কিছু শেখানো শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণের সবচেয়ে মধুর ও কার্যকর পন্থাগুলোর অন্যতম। কাহিনী বা ইতিহাস বর্ণনা পবিত্র কুরআনেরও অন্যতম রীতি। গল্প বা কাহিনী মানুষের বিশ্বাসের ওপর অত্যন্ত জোরালো প্রভাব ফেলে।  থিয়েটার, নাটক ও চলচ্চিত্র এবং কথা-সাহিত্য বা গল্প-উপন্যাসের জনপ্রিয়তার রহস্যও মূলত গল্প-কেন্দ্রিকতা! শিশু-কিশোরদের মানসিক সমস্যা ও স্নেহ-অনুভূতির ঘাটতিজনিত সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এসব মাধ্যমকে অনেক মনোবিশেষজ্ঞ কার্যকর ওষুধ হিসেবেও ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন।

মনোবিজ্ঞানীরা শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণে গল্প শোনানোর ব্যাপক কার্যকারিতার কথা বলে আসছেন। এরই আলোকে বাবা-মায়েদের প্রতি তাদের পরামর্শ দিচ্ছেন হচ্ছে তারা যেন নিজ সন্তানদেরকে শৈশব থেকেই গল্প শোনানোর ব্যবস্থা করেন বা নিজেরাই গল্প বলতে কার্পণ্য না করেন। 

গল্প বিশ্বের প্রাচীনতম শিল্পের অংশ। প্রাগৈতিহাসিক যুগের যেসব গুহাচিত্র দেখা যায় সেসবের মধ্যেও রয়েছে গল্পের বর্ণনা। মানুষ সামাজিক ও আত্মিক প্রয়োজন মেটাতে সৃষ্টি করেছে গল্প। শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে গল্প বর্ণনার রয়েছে ব্যাপক প্রভাব। সৌন্দর্যবোধ, সৃষ্টিশীলতা, সাহসিকতা, বীরত্ব, মানবপ্রেম, স্বাধীনতার চেতনা, প্রতিরোধ, আশাবাদ, অন্যায়-অবিচার বা জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম -এই জাতীয় অনেক বিষয় গল্পের মাধ্যমে খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয় বলে সেসব পড়ানোর মাধ্যমে শৈশবেই শিশুদের মনে এসবের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করা সহজেই সম্ভব।

শিশুদের ভাষা-জ্ঞান, কল্পনা-শক্তি, উপলব্ধির ক্ষমতা ও পারিপার্শ্বিক জগতের সঙ্গে সম্পর্ক বা যোগাযোগ গড়ে তোলার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যও সহায়ক হল গল্প-বর্ণনা। শিশুদেরকে শুদ্ধ উচ্চারণ শেখানো,  চিন্তাশীল করা, নীরব রেখে কথা শোনার ধৈর্য শেখানো ও মনোযোগী হওয়ার মত আরও অনেক দিকে দক্ষ করার জন্য গল্প বর্ণনার মত ভালো মাধ্যম আর নেই বা খুব কমই রয়েছে।

গল্প বর্ণনার মাধ্যমে বাবা-মায়ের সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক জোরদার ও তাদের কণ্ঠকে শিশুর কাছে পরিচিত করাও সহজ হয়। গল্প বর্ণনার মাধ্যমে উপদেশ দেয়াটা যতটা ফলপ্রসু হয় প্রত্যক্ষ উপদেশ ততটা কার্যকর হয় না।  মানুষকে সচেতন করার ক্ষেত্রে গল্পের যাদুকরি ক্ষমতা থাকায় প্রাচীন যুগ থেকেই গল্পের বাজার রমরমা। আর বিখ্যাত বহু গল্প মানুষ মুখে বর্ণনার মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে তা জিইয়ে রেখেছে।

গল্পের প্রতি আকর্ষণ শিশু-কিশোরদের মজ্জাগত স্বভাব। যুগে যুগে নানা ধর্ম গ্রন্থও মানুষকে সুপথ দেখানোর জন্য গল্প বা কাহিনী তুলে ধরেছে। পবিত্র কুরআনও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে কুরআনের কাহিনীগুলো শ্রেষ্ঠ ও বাস্তব।  শৈল্পিক দিকসহ সব দিক থেকেই এসব কাহিনী শ্রেষ্ঠ। কুরআনের কাহিনী/ বর্ণনা বা উপস্থাপনার নৈপুন্যের দিক থেকেও শ্রেষ্ঠ যা এর অলৌকিকতারই প্রমাণ। কেবল শৈল্পিক বা সাহিত্যিক মানের জন্যই কুরআনের কাহিনী শ্রেষ্ঠ নয়, শিক্ষণীয় বাস্তবতাকে খুব সহজভাবে তুলে ধরা ও স্পষ্ট করার ক্ষেত্রেও তা শ্রেষ্ঠ। কুরআনের কাহিনীগুলো কল্প-কাহিনী নয়। এইসব গল্পের নায়করা ছিলেন বাস্তব জগতের সুপথ-প্রাপ্ত মানুষ ও মানবজাতির জন্য চির-বরেণ্য আদর্শ। কুরআনের কাহিনীগুলোর নেতিবাচক চরিত্রগুলো বা মন্দ লোকদের পরিণতিতে রয়েছে সব যুগের মানুষের জন্য জ্বলন্ত শিক্ষা।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পবিত্র কুরআনের কাহিনীগুলোর নায়ক বা মহানায়করা হলেন নবী-রাসুল যারা সব যুগের মানুষের জন্য সুপথ বা হেদায়াতের আদর্শ। তাঁদের অনন্য নানা গুণ ও পবিত্রতার কারণে মানুষ তাঁদের ভালবাসেন ও শ্রদ্ধা করেন। ঈসমাইল নবীর কাহিনী থেকে আমরা পাই মহান আল্লাহর নির্দেশে আত্মত্যাগের মত সুউচ্চ খোদাপ্রেমের শিক্ষা তথা আল্লাহর পথে জীবন কুরবানি করার খোদায়ি নির্দেশকে আন্তরিক চিত্তে মেনে নেয়ার শিক্ষা।  ইয়াকুব নবীর ঘটনা থেকে আমরা ধৈর্য ও আল্লাহর ওপর নির্ভর করার শিক্ষা পাই। ইউসুফ নবীর ঘটনা থেকে আমরা চরিত্রকে পবিত্র রাখার এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার শিক্ষা পাই। কুরআনে বর্ণিত এইসব কাহিনী যতবারই পড়া হয় ততবারই নতুন নতুন শিক্ষণীয় বার্তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাঠকের কাছে। তাই বাবা-মা ও অভিভাবকদের উচিত তাদের প্রত্যেক সন্তানকে সর্বোচ্চ মাত্রায় কুরআনের কাহিনীগুলোর সঙ্গে পরিচিত করা ও সহজ ভাষায় সেসব কাহিনী তুলে ধরে সেসবের উচ্চতম ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষণীয় দিকগুলো তাদের কাছে স্পষ্ট করে দেয়া।

শিশুদের নিজস্ব জগত যেন গল্পেরই জগত। তারা সেই জগতেই খেলে ও সেখানেই ঘুমায় ও সেখানেই জেগে ওঠে। সবচেয়ে খেলা-পাগল শিশুও গল্প শুনতে চায়। তারা গল্প শুনে তা থেকে অনেক কিছু শেখে ও স্বপ্নের জগতেও গল্পের ঘটনার পেছনে ছুটে বেড়ায়। গল্প বর্ণনাকারীকে হতে হবে শিশুর মন ও পছন্দের বিষয়ে অভিজ্ঞ। আর তাহলেই তিনি শিশুর মনের মধ্যে গল্পের মাধ্যমে রোপন করতে পারবেন বড় বড় মূল্যবোধ ও নৈতিক মূল্যবোধের বীজসহ সব ধরনের আকর্ষণীয় এবং জরুরি শিক্ষা আর মূল্যবোধের বীজগুলো। আর এভাবেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারগুলো স্থানান্তর করতে হবে এক প্রজন্ম থেকে আরে প্রজন্মের মধ্যে গভীর সযত্নের সঙ্গে।#

পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/০১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ