ডিসেম্বর ০৯, ২০২১ ১৫:৩৫ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ইরাক-ইরান যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব পাস সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের আসরে আমরা ওই প্রস্তাব সম্পর্কে ইরানের অবস্থান এবং তখন পর্যন্ত যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে কথা বলব।

৫৯৮ নম্বর প্রস্তাবের আগে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ থেকে যতগুলো প্রস্তাব পাস হয় তার সবগুলোতে ইরান ও ইরাক উভয় পক্ষকে যুদ্ধ বন্ধ করে সংযত আচরণ করার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু এসব প্রস্তাবে একবারের জন্যও এ প্রশ্ন করা হয়নি যে, ইরাক কেন আগে যুদ্ধ শুরু করেছে। অথচ ইরানে সাদ্দামের আগ্রাসন বন্ধ হওয়ার দুই বছর পর ইরাক যখন কুয়েত দখল করে তখন আমেরিকা সরাসরি কুয়েতের পক্ষ নেয়। ১৯৯০ সালের আগস্টে ইরাকি সেনারা কুয়েতে অনুপ্রবেশ করার পর দেশটি থেকে আগ্রাসী সেনাদের বের করে দেয়ার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেয় মার্কিন সরকার। কিন্তু এই ইরাক যখন এর আগে ইরানে আগ্রাসন চালায় তখন আমেরিকা উল্টো বাগদাদের পক্ষ নেয়। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরান আমেরিকার তাবেদারি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে তেহরানকে কার্যত ‘কানমলা’ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ওয়াশিংটন।

৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইরাকের সাদ্দাম সরকার তা মেনে নেয়। বসরার পূর্বাঞ্চলে ইরানের পক্ষ থেকে চালানো কারবালা-৫ অভিযানে পর্যুদস্ত হওয়ার কারণে ইরাক সরকার এ পদক্ষেপ নেয়। প্রস্তাবটি পাস করার জন্য বাগদাদ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে ধন্যবাদ জানায়। কিন্তু ১৯৮৭ সালের ২১ জুলাই ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাবকে স্ববিরোধী বক্তব্যে ভরপুর বলে বর্ণনা করে। প্রস্তাবটি সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করে বিবৃতিতে বলা হয়, প্রস্তাবে ইরাক-ইরান যুদ্ধ কে শুরু করেছিল তা নির্ধারণ করতে হবে। তবে ইরানের দৃষ্টিতে তখন পর্যন্ত জাতিসংঘের পক্ষ থেকে প্রকাশিত প্রস্তাবগুলোর মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে ভালো প্রস্তাব। কারণ, যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য এতে প্রথমবারের মতো ইরানের অনেকগুলো দাবি মেনে নেয়া হয়েছিল।

প্রস্তাবে যুদ্ধ শুরুর জন্য দায়ী দেশকে চিহ্নিত করা না হলেও বিষয়টি নিয়ে তদন্তের কথা বলা হয়েছিল।  এ সংক্রান্ত ধারাটিতে বলা হয়, তদন্ত সাপেক্ষে ইরান নাকি ইরাক এ যুদ্ধ শুরু করেছে তা নির্ধারণ করা হবে। ইরান ওই ধারাটিকে সবার আগে নিয়ে আসার আহ্বান জানায়। এর আগে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো ইরান প্রত্যাখ্যান করা হলেও এবারের প্রস্তাবটি দুই মাস পর তেহরান শর্তসাপেক্ষে মেনে নেয়। ইরান ঘোষণা করে, জাতিসংঘ মহাসচিব পেরেজ ডি কুয়েয়ার যদি ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাবে একটি সম্পূরক প্রটোকল যোগ করেন তাহলে প্রস্তাবটি মেনে নেয়া হবে।  ১৯৮৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ইমাম খোমেনীর উপস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডাররা এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ইরাককে এই যুদ্ধ শুরুর জন্য দায়ী ঘোষণা করতে জাতিসংঘ মহাসচিবকে অনুরোধ জানানো হবে।

কিন্তু ইরানের এ শর্ত মেনে নিতে জাতিসংঘ প্রস্তুত ছিল না। আমেরিকার প্রভাবাধীন এই বিশ্ব সংস্থার বক্তব্য ছিল একটাই- ইরানকে বিনা বাক্যব্যয়ে প্রস্তাবটি মেনে নিতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ইমাম খোমেনী (রহ.) ১৯৮৭ সালের ২৯ নভেম্বর সেনা কমান্ডারদের উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে বলেন, জাতিসংঘে আমরা রাজনৈতিক তৎপরতা চালাবো এবং সেইসঙ্গে যুদ্ধের ময়দানেও শত্রুর বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে যেতে হবে। তিনি জাতিসংঘে গিয়ে ইরানের পক্ষে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন।

ওদিকে ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাবটি বিনা বাক্যব্যয়ে ইরানকে মেনে নিতে বাধ্য করার জন্য এ সময় আমেরিকা বলপ্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। পারস্য উপসাগরে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি বেড়ে যায় এবং সন্ত্রাসী মার্কিন সেনাদেরকে অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান করা হয়। দৃশ্যত, পারস্য উপসাগরে পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় মার্কিন সেনারা।

ইরাকি বাহিনীর আগ্রাসনের মুখে ইরান যাতে পাল্টা হামলা চালাতে না পারে আমেরিকা সে উদ্যোগ গ্রহণ করে। কার্যত পারস্য উপসাগরে মোতায়েন মার্কিন সেনারা ইরাকি বাহিনীর পক্ষ হয়ে যুদ্ধংদেহী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আমেরিকা ইরাককে আত্মরক্ষামূলক অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিতে উসকানি দেয় এবং ইরানের দখলে থাকা ভূমি পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানায়। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ইরান যাতে সমরাস্ত্র সংগ্রহ করতে না পারে সেজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায় ওয়াশিংটন। আমেরিকা ইরানের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা কঠোর করে যার ফলে চীন পর্যন্ত তেহরানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে অপারগতা প্রকাশ করে।

এ অবস্থায় ইরান এক জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়। একদিকে যুদ্ধের ময়দানে শক্তিশালী অবস্থানে থাকার কারণে যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব মেনে নেয়া তার জন্য ছিল কঠিন। অন্যদিক তেহরানের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে না নিয়ে অন্যায়ভাবে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক সমাজ ইরানের ওপর চাপ বৃদ্ধি করে যাচ্ছিল। এরকম জটিল পরিস্থিতিতে পশ্চিম ফ্রন্ট দিয়ে ইরাকের ওপর বড় ধরনের আক্রমণ চালিয়ে যুদ্ধে আরো বেশি সুবিধাজনক অবস্থান গ্রহণ করা ছাড়া ইরানের সামনে অন্য কোনো উপায় ছিল না। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে যেসব অভিযান চালানো হয় ওয়ালফাজর-১০ সেগুলোর অন্যতম। কিন্তু এই অভিযানে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাওয়া যায়নি। ১৯৮৭ সালের আগ পর্যন্ত ইরান যতগুলো অভিযানে বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছিল সেগুলোর বেশিরভাগ চালানো হয়েছিল দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে।

কিন্তু ১৯৮৭ সালে ইরাকি বাহিনী দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে নিজের উপস্থিতি শক্তিশালী করে। পাশাপাশি পারস্য উপসাগরে মার্কিন সেনা মোতায়েন করার ফলে ইরানকে ইরাকি বাহিনীর পাশাপাশি সন্ত্রাসী মার্কিন সেনাদের দিকেও নজর রাখতে হয়। এই সুযোগে ইরাকি বাহিনী নিজেকে শক্তিশালী করে নেয়ার যথেষ্ট সুযোগ পায় এবং সাদ্দাম সরকার সে সুযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করে।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /০৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।