ডিসেম্বর ২৫, ২০২১ ১৮:৪৯ Asia/Dhaka

বলা হয়ে থাকে বর্তমান যুগ হচ্ছে বিজ্ঞাপনের যুগ। তবে এমন অবস্থায় পৌঁছাতে বহু চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে এই খাতকে। অতীতেও বিজ্ঞাপনের অস্তিত্ব ছিল তবে দু'টি ঘটনা এই ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে।

প্রথমটি হলো মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার। ১৪৫০ সালে প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে যেকোনো অক্ষর ও ছবি প্রকাশ সহজ হয়। আর দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো শব্দ প্রচার যন্ত্রের আবিষ্কার। বিংশ শতাব্দীতে এই যন্ত্র আসায় অনেক দূরেও বার্তা ও শব্দ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়। বর্তমান যুগকে যোগাযোগের যুগও বলা হয়। গবেষকেরা সব সময় মানুষের ওপর গণযোগাযোগের নানা মাধ্যমের বিস্ময়কর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। এখন এটা প্রমাণিত সত্য যে, গণমাধ্যম মানুষের আচার-আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গিতেও ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করতে পারে। জনমত গঠনে সহযোগিতা করতে পারে এমনকি গণমাধ্যম মানুষের জীবন পদ্ধতিই পাল্টে দিতে পারে। একারণে বিজ্ঞাপন শিল্পের উন্নতি ও অগ্রগতির উপযুক্ত ক্ষেত্র হচ্ছে গণমাধ্যম।

আমরা এখন এমন একটা সময়ে বসবাস করছি যখন সমাজের বেশিরভাগ মানুষের তথ্য-বিশ্লেষণ ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর মিডিয়ার কম-বেশি প্রভাব রয়েছে। বিশেষকরে গণমাধ্যমে কী ধরণের বিজ্ঞাপন যাচ্ছে অথবা কী ধরণের প্রবণতা হাইলাইট হচ্ছে তার ওপর অনেকের প্রাত্যহিক জীবন-পদ্ধতি নির্ভর করে। সমাজের একটা বড় অংশই গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপন দেখে পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্য তালিকা নির্ধারণ করেন। এ কারণে বিজ্ঞাপন খাতে ক্রমেই পুঁজি বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় এই খাতে। বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো তাদের বিজ্ঞাপনকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। তারা মানুষের হৃদয়-মনে প্রভাব ফেলতে দক্ষ মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও শিল্পীদের নিয়োগ দিচ্ছে। রেডিও-টিভি, পত্রিকা, সিনেমা, ম্যাগাজিন, কম্পিউটার গেমসহ সর্বত্রই চোখে পড়ে হরেক রকমের বিজ্ঞাপন। রাস্তা দিয়ে হাঁটলেও চোখে পড়ে বিশাল বিশাল বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপনের দাপট।

শুধু তাই নয় অনেক দেশে এখন ফুটপাত দিয়ে চলার সময় নিচের দিকে তাকালেও বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। ফুটপাতে লাগিয়ে রাখা হয়েছে নানা ধরণের পোস্টার, সেগুলো মাড়িয়ে সামনে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এখন ইন্টারনেটেও বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। সবার একই লক্ষ্য আর তাহলো মানুষের মাঝে চাহিদা তৈরি করা, ক্রেতা আকৃষ্ট করা এবং বেশি বেশি পণ্য বিক্রি করা। পৃথিবীতে টেলিভিশনে প্রথম পণ্যের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে প্রায় ৮০ বছর আগে। ১৯৪১ সালের পহেলা জুলাই নিউ ইয়র্কের টিভি স্টেশন থেকে হঠাৎ স্বল্প সময়ের জন্য স্বাভাবিক অনুষ্ঠান সম্প্রচার স্থগিত রেখে কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বুলোভা ঘড়ির বিজ্ঞাপন শুরু হয়। ৬০ সেকেন্ড ধরে কেবল বুলোভা ঘড়ি দেখানো হয়। এরপর আবার তাদের নিয়মিত অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করতে থাকে টিভি কর্তৃপক্ষ। যদিও এই বিজ্ঞাপনটি তেমন ভালো মানের কোনো বিজ্ঞাপন ছিল না, কিন্তু এটিই প্রথম টিভি বিজ্ঞাপন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপনের ধরণে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, বিজ্ঞাপন শিল্প খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে এবং নতুন নতুন কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে মূল বিষয়টিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি অর্থাৎ আগেও যেমন মানুষের মধ্যে পণ্য কেনার অনুভূতি জাগানোই ছিল বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য এখনও তাই।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এখন এই ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে, বর্তমানে বিজ্ঞাপন ছাড়া শিল্পখাতকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। অনেকেই মনে করেন, ভোগের সংস্কৃতিকে জিইয়ে রাখতে বিজ্ঞাপনই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। আর ভোগের সংস্কৃতির অবসান হলে শিল্প টিকে থাকবে না, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিরও প্রসার ঘটবে না। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বে প্রতি বছর বিজ্ঞাপন খাতকে ঘিরে অর্থের লেনদেন হয় প্রায় এক থেকে দুই ট্রিলিয়ন ডলার। বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন যে কেবল অর্থনীতির উপরই প্রভাব ফেলে তা কিন্তু নয়, এর প্রভাব পড়ে সমাজ ও সংস্কৃতির ওপরও। সমাজে নতুন প্রবণতা চালু করতে বিজ্ঞাপনের জুড়ি নেই। সারা বিশ্বেই যেসব বিষয়ে বিজ্ঞাপন বেশি চোখে পড়ে সেগুলোর একটি হলো খাদ্যপণ্য। ২০১২ সালে মারলিন কেলার খাদ্যপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি সংক্রান্ত এক নিবন্ধে লিখেছেন, প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞাপনের প্রভাবে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধেই পরিবর্তন এসেছে। পারিবারিক ভোগের মডেল পাল্টে গেছে।

পাঠক, দর্শক ও শ্রোতাদের চিন্তা ও মননে বিজ্ঞাপন এতটাই প্রভাব ফেলেছে যে, খাদ্যপণ্য কেনার আগ্রহ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। মিডিয়া এমনভাবে আকর্ষণীয় করে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের বিজ্ঞাপন দেয় যে, তা খাদ্যাভ্যাসকেও প্রভাবিত করে। এর ফলে খাদ্যপণ্যের বাজারেও প্রভাব পড়ে। অবশ্য এর নেতিবাচক দিকও রয়েছে। টিভি বিজ্ঞাপন থেকে প্রভাবিত হয়ে খাদ্যাভ্যাস গড়ার কারণে অনেকের বিশেষকরে শিশুদের নানা রোগ হচ্ছে, শিশুদের একটা বড় অংশ স্থূলতার সমস্যায় ভুগছে। চীন ও আমেরিকার শিশুদের ওপর পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা নানা ধরণের চিত্তাকর্ষক বিজ্ঞাপন দেখে নানা ধরণের পানীয় ও চিপসের মতো খাদ্যের প্রতি মারাত্মক আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে এবং নিয়মিত এগুলো কিনে খাচ্ছে। শিশুদের আকৃষ্ট করতে কোম্পানিগুলো এমন সব কৌশল অবলম্বন করছে যেগুলো শিশুরা পছন্দ করে। এ লক্ষ্যে অ্যানিমেশন তৈরি করা হচ্ছে, বিজ্ঞাপনে শিশুদের পছন্দনীয় ব্যক্তিত্বদের দিয়ে অভিনয় করানো হচ্ছে। কখনো কখনো দেখানো হচ্ছে জনপ্রিয় শিশু অভিনেতারা এসব খাবারের ভক্ত, কাজেই সব শিশুর উচিৎ এসব খাদ্য গ্রহণ করা।

ব্রিটেনে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, টিভি বিজ্ঞাপন শিশুদের মধ্যে চর্বিযুক্ত ও মিষ্টি জাতীয় খাবার গ্রহণের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে। ব্রিটেনের ১১ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে স্থূলতার সমস্যা ব্যাপক। ব্রিটেনের শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ক রয়েল কলেজের গবেষণায় দেখা গেছে শিশু-কিশোরদের ওজন কমানোর একটি উপায় হলো ফাস্টফুডসহ অস্বাস্থ্যকর খাবারের বিজ্ঞাপন সীমিত করা। ব্রিটেনের স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ক বিভিন্ন সংস্থা দাবি জানিয়েছে, শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষায় ব্যাপক চর্বি, চিনি ও লবণ মিশ্রিত খাবারের বিজ্ঞাপন যেন রাত নয়টার আগে টিভিতে প্রচার করা না হয়। একইসঙ্গে শিক্ষা ও বিনোদন কেন্দ্রের আশেপাশে যেসব ফাস্টফুডের দোকান রয়েছে সেগুলোর সংখ্যাও যেন কমানো হয়। তারা সরকারের সমালোচনা করে বলেছে, ক্ষতিকর খাবারের বিজ্ঞাপনের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে শিশুরা। এত বেশি বিজ্ঞাপন রেখে শিশুদেরকে ক্ষতিকর খাবার থেকে দূরে রাখাটা অত্যন্ত কঠিন।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ২৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ