ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (পর্ব-৯৫): ওয়ালফাজর-১০ অভিযান
গত আসরে আমরা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য করার জন্য ইরানের উপর চতুর্মুখী চাপ প্রয়োগ সম্পর্কে কথা বলেছি। আজ আমরা ওই যুদ্ধে আমেরিকার সরাসরি অংশগ্রহণ ও ইরানের পক্ষ থেকে চালানো ওয়ালফাজর-১০ অভিযান নিয়ে আলোচনা করব।
আমেরিকা মূলত যুদ্ধ শুরু করার জন্য দায়ী দেশকে চিহ্নিত না করেই ইরানকে যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করার জন্য প্রকাশ্যে ইরাকের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয়। ইরাকি শাসক সাদ্দাম এই ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে দু’দেশের জনগণের যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছিল সেজন্য তার বিচার করা ছিল আন্তর্জাতিক সমাজের দায়িত্ব। কিন্তু তারা তা না করে সাদ্দামকে নিরাপদ প্রস্থানের সুযোগ করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়। আমেরিকা ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে পারস্য উপসাগরে আনুষ্ঠানিকভাবে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়। ১৯৮৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সোমবার রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে পারস্য উপসাগরে মোতায়েন একটি মার্কিন ফ্রিগেট থেকে দু’টি হেলিকপ্টার গানশিপ উড্ডয়ন করে এবং এগুলো ইরানের নৌবাহিনীর ৮০০ টন ওজনের একটি লজিস্টিক জাহাজে হামলা চালায়। এতে ইরানের পাঁচ নাবিক নিহত হন যাদের মধ্যে দু’জনের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এরপর মার্কিন ফ্রিগেটটি ইরানের ওই জাহাজটিকে অবশিষ্ট ২৬ নাবিকসহ আটক করে নিয়ে যায়। সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন সেনারা ওই ঘটনার পাঁচদিন পর পারস্য উপসাগরে ইরানি জাহাজটিকে বিস্ফোরকের সাহায্যে উড়িয়ে দেয়। জাহাজটি ধ্বংস করার জন্য আমেরিকা এই অজুহাত তোলে যে, সাগরে মাইন স্থাপনের কাজে ইরান এটি ব্যবহার করছিল।
এরপর ১৯৮৭ সালের ৮ অক্টোবর দু’টি মার্কিন অ্যাপাচি হেলিকপ্টার থেকে পারস্য উপসাগরের গভীর সমুদ্রে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র তিনটি গানবোটে হামলা চালানো হয়। এ সময় আইআরজিসি’র যোদ্ধারা গুলি করে একটি মার্কিন হেলিকপ্টার ভূপাতিত করেন। এরপর আমেরিকা ঘটনাস্থলে আরো পাঁচটি হেলিকপ্টার পাঠায় এবং আইআরজিসি’র কয়েকটি গানবোটে হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজন ইরানি যোদ্ধাকে হতাহত করে। এ ঘটনার পর হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া ইরানি নাবিকদেরকে তাদের গানবোটগুলোসহ আটক করে নিয়ে যায় মার্কিন সেনারা।
১৯৮৭ সালের ১৯ অক্টোবর চারটি মার্কিন ডেস্ট্রয়ার থেকে পারস্য উপসাগরে অবস্থিত একটি ইরানি তেল রপ্তানিকারক প্ল্যাটফর্মে হামলা চালানো হয়। হামলায় ‘রেশাদাত’ নামের ওই তেল প্ল্যাটফর্মে ব্যাপকভাবে আগুন ধরে যায়। এখন থেকে ইরান প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ হাজার ব্যারেল তেল রপ্তানি করত। কিন্তু এটিতে আগুন লেগে যাওয়ায় ইরানের ৫০ কোটি ডলারেরও বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়। এদিন ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী ও তার সহযোগীদের সমুচিত জবাব দেয়ার নির্দেশ দেন। ওই ঘটনার তিন দিন পর কুয়েতের আহমাদি বন্দরে অবস্থতি ‘সি আইল্যান্ড’ তেল ডিপোতে একটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে এবং এর ফলে ওই ডিপোর অপূরণীয় ক্ষতি হয়। পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে এই হামলার ঘটনা ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
ইরানের তেল ডিপোতে আমেরিকার হামলার জবাব দেয়ার পাশাপাশি মার্কিন সেনাদের পারস্য উপসাগরে ডেকে আনার জন্য কুয়েতকে শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকে ওই হামলা চালায় ইরান। কুয়েতের আহমাদি বন্দরে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ছিল আমেরিকার জন্য একটি চরম অপমান। ওই হামলার ফলে কুয়েতের দৈনিক তেল রপ্তানির পরিমাণ কমে ১২ লাখ ব্যারেলে নেমে আসে। ওই ঘটনার পর মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পেন্টাগনের একজন কর্মকর্তা বলেন: রোনাল্ড রিগ্যান প্রশাসন এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন হলেও এর প্রতিশোধ নেয়ার কোনো ইচ্ছা ওয়াশিংটনের নেই।
এদিকে ইরানকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মানতে বাধ্য করার প্রচেষ্টা চালানোর পাশাপাশি আমেরিকা নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে ইরানের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেষ্টা শুরু করে। অন্যদিকে ইরাক যাতে পারস্য উপসাগরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা ইরানি তেল স্থাপনাগুলোতে নির্বিঘ্নে হামলা চালাতে পারে সেজন্য ইরাককে দূরপাল্লার জঙ্গিবিমান সরবরাহ করে আমেরিকা।
এদিকে ইরান যাতে প্রতিপক্ষের তেল স্থাপনায় পাল্টা আঘাত হানতে না পারে সেজন্য ইরানের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের উদ্যোগ নেয় সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা। এ সময় ইরান জাতিসংঘকে জানায়, এই সংস্থা যদি যুদ্ধ শুরু করার জন্য ইরাককে দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করে তাহলে নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নিতে তেহরান প্রস্তুত রয়েছে। পাশাপাশি যুদ্ধের ময়দানেও ইরাকের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করার চেষ্টা করে ইরান। এছাড়া, জাতিসংঘের আরোপিত অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য ইরান ক্ষেপণাস্ত্রসহ অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র আমদানি না করে দেশের ভেতরেই উৎপাদন করার উদ্যোগ নেয়।
ইরান যখন নতুন অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইরাকি দূরপাল্লার যুদ্ধবিমান ইরানের রাজধানী তেহরানের একটি তেল শোধনাগারে হামল চালায়। ওই ঘটনার দু’দিন পর ইরাকি বাহিনী প্রথমবারের মতো ইরানের চারটি স্থানে ভূমি থেকে ভূমিতে নিপেক্ষযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়। ওই দিনই ইরান ইরাকের রাজধানী বাগদাদকে লক্ষ্য করে একটি স্কাড-বি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। দু’দেশের পক্ষ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ও পাল্টা নিক্ষেপের ঘটনা চলতে থাকে। তবে ইরাকের প্রতি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তির সার্বিক সহযোগিতার প্রেক্ষাপটে ইরাকি বাহিনীর নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা ইরানের পক্ষ থেকে নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। সে সময় ইরানের নিজস্ব কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ছিল না বরং বাইরে থেকে এই সমরাস্ত্র আমদানি করতে হতো।
ইরাকের আগ্রাসী সাদ্দাম বাহিনী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যতদিন ইরান ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে না নেয় ততদিন ইরানের আবাসিক এলাকা ও শহরগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অব্যাহত থাকবে। এদিকে ইরান নিজের নাগরিকদের ইরাকি হামলা থেকে রক্ষা করার জন্য ভূগর্ভস্থ আশ্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে এবং যারা শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলের দিকে চলে যেতে চায় তাদেরকে সহযোগিতা করে।
ইরান সব মনে করে আসছিল যে, ইরাকের সঙ্গে চলমান যুদ্ধ বন্ধে বাগদাদের ওপর রাজিনৈতিক চাপ প্রয়োগ তখনই সম্ভব হবে যখন যুদ্ধের ময়দানে সাদ্দাম বাহিনীকে চাপের মধ্যে ফেলা যাবে। এ কারণে আরেকটি বড় ধরনের অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নেয় ইরান। ১৯৮৮ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি দেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ওই অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়।
১৯৮৮ সালের ১৩ মার্চ ‘ওয়ালফাজর-১০’ নামের ওই অভিযান চালানো হয়। ইরাকি বাহিনী দক্ষিণ ফ্রন্ট দিয়ে ইরানি হামলা প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত ছিল বলে উত্তরাঞ্চল দিয়ে চালানো এই অভিযানে সাদ্দাম বাহিনী অনেকটা হতচকিত হয়ে পড়ে। ক্ষিপ্রগতিতে চালানো অভিযানে ইরানের আগে থেকে নির্ধারিত লক্ষ্যের প্রায় ৯০ ভাগই অর্জিত হয়। এক সপ্তাহব্যাপী ওই অভিযানে ইরাকের হালাবচে শহর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো ইরানের দখলে চলে আসে। অভিযানে ইরাকি বাহিনীর ৫,৪৪০ সৈন্য এবং ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থা বিরোধী ৪০০ দালালও ইরানি যোদ্ধাদের হাত বন্দি হয়। ওয়ালফাজর-১০ অভিযানে ইরাকি বাহিনী ব্যাপকভাবে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /২৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।