ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (পর্ব-৯৬): সাদ্দাম বাহিনীর রাসায়নিক বোমা হামলা
গত আসরে আমরা ইরানের পক্ষ থেকে চালানো ওয়ালফাজর-১০ অভিযান নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা যুদ্ধের শেষ বছরের সার্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি ইরাকের হালাবজা শহরে সাদ্দাম বাহিনীর রাসায়নিক বোমা হামলা নিয়ে কথা বলব।
ওয়ালফাজর-১০ অভিযানের মাধ্যমে ইরান ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় হালাবজা শহর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো দখল করে। এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইরাকের সোলায়মানিয়া প্রদেশের সঙ্গে সেদেশের সম্পর্ক ছিন্ন করা। কিন্তু ইরানি যোদ্ধারা প্রদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর হালাবজা দখল করলেও সোলায়মানিয়া শহর দখল করতে ব্যর্থ হন। ওদিকে ইরাকি বাহিনী এবার ইরানি যোদ্ধাদের মোকাবিলা করার জন্য অন্যান্য ফ্রন্ট থেকে কোনো সেনা তলব করেনি। বরং স্থানীয়ভাবে ইরানি সৈন্যদের মোকাবিলা করে এবং ইরানি যোদ্ধাদের উপর রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে। সে সময় ৭০ হাজার অধিবাসীর শহর হালাবজা ছিল ইরাক-নিয়ন্ত্রিত কুর্দিস্তানের সবচেয়ে সুন্দর শহর।
ইরান ওয়ালফাজর-১০ অভিযানে বিজয়ী হওয়ার পর ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম নিজে হালাবজা শহরের উপর রাসায়নিক হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। ১৯৮৮ সালের ১৬ মার্চ এই শহরের নিরপরাধ নাগরিকদের উপর ভয়াবহ রাসায়নিক হামলা চালায় ইরাকি বাহিনী। সারদাশত শহরে রাসায়নিক হামলা চালানোর প্রায় সাত মাস পর হালাবজায় এই রাসায়নিক বোমাবর্ষণ করা হয়। ওই দিন ফ্রান্সের কাছ থেকে পাওয়া ৫০টি জঙ্গিবিমান হালাবজা শহর ও এর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে বোমাবর্ষণে অংশ নেয়। প্রতিটি যুদ্ধবিমান ৫০০ কেজি ওজনের চারটি রাসায়নিক বোমা নিক্ষেপ করে। ওই দিন সকালে শহরের নারী, পুরুষ ও শিশুরা যখন অন্য দিনগুলোর মতো কোলাহলপূর্ণ জীবন শুরু করেছিল তখনই তাদের উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ে।
নিজ দেশের শাসকের পক্ষ থেকে পাঠানো অসংখ্য যুদ্ধবিমানে ছোট্ট শহরটির আকাশ ছেয়ে যায় এবং মুহূর্মুহূ বোমার আঘাতে দলে দলে মানুষের লাশ পড়তে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই হালাবজা শহর ও এর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর দৃশ্যপট বদলে যায় এবং সড়ক ও মহাসড়কগুলো হাজার হাজার মানুষের মৃতদেহতে পূর্ণ হয়ে যায়।
হালাবজায় রাসায়নিক হামলা চালানোর মাধ্যমে ইরাকি শাসক সাদ্দাম তার সবচেয়ে জঘন্য যুদ্ধাপরাধটি সংঘটিত করে। মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে হালাবজা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোর প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ নিহত এবং আরো সাত হাজার মানুষ আহত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তখন পর্যন্ত এটি ছিল পৃথিবীর যেকোনো স্থানে সবচেয়ে বড় রাসায়নিক অস্ত্রের হামলা। এই হামলার সঙ্গে কেবলমাত্র জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে আমেরিকার পক্ষ থেকে চালানো পারমাণবিক বোমা হামলার তুলনা করা যায়। হালাবজা শহরে রাসায়নিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট ইরাকি নাগরিক ইরানে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয় এবং সেখানকার আহত মানুষদেরকেও ইরান চিকিৎসা দেয়। আহতদের অনেককে উন্নত চিকিৎসার জন্য ইউরোপে পাঠানো হয়। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ শুলৎজ ইরাকি বাহিনীর রাসায়নিক বোমা হামলার ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, “আমরা একদিকে যেমন রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরোধী ছিলাম তেমনি ইরাকের ওপর ইরান বিজয়ী হোক- তাও চাইনি। এ কারণে আমরা রাসায়নিক হামলা চালানোর জন্য সাদ্দাম সরকারের নিন্দা জানাইনি।”
ইরানের পক্ষ থেকে চালানো ওয়ালফাজর-১০ অভিযানের এলাকায় এই রাসায়নিক হামলার পাশাপাশি ইরানের অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উপর ইরাকি বাহিনীর একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলার ফলে যুদ্ধের ভারসাম্য ইরাকের পক্ষে চলে যেতে থাকে। ইরাকের সাদ্দাম সরকার তার সেনাশক্তির মূল অংশকে দক্ষিণাঞ্চলে মোতায়েন রেখে উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে ইরানি যোদ্ধাদের হামলা প্রতিহত করার কাজে স্থানীয় বাহিনীগুলোকে ব্যবহার করে। আর ইরাকি বাহিনীর যেখানে প্রচলিত যুদ্ধে ইরানের সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন হয়ে যায় সেখানে তারা রাসায়নিক অস্ত্রের মতো অপ্রচলিত যুদ্ধের আশ্রয় নেয়।
১৯৮৮ সালের মার্চ মাসের শেষদিকে এবং এপ্রিল মাসের গোড়ার দিকে ইরানের ওপর ইরাকের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়। ইরাকি বাহিনী আরো বেশি আগ্রাসী হয়ে ওঠে এবং ইরানের শহর ও গ্রামগুলো লক্ষ্য করে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ও বিমান হামলা প্রকট আকার ধারণ করে।
১৯৮৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ৫১ দিন ইরানের শহরগুলোতে বিরতিহীনভাবে হামলা চালিয়ে যায় ইরাক। এ সময়ে ইরাকি বাহিনী ইরানের রাজধানী তেহরানে অন্তত ১০০টি এবং ইরানের অন্যান্য শহরে আরো প্রায় ১০০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এর ফলে ইরানের বেসামরিক স্থাপনা ও সাধারণ নাগরিকদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। সাদ্দামের নেতৃত্বাধীন ইরাকি বাহিনী একইসঙ্গে নির্দয়ভাবে ইরানের উপর রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করতে থাকে।
যুদ্ধের শেষ এক বছরে ইরানের বেসামরিক অবস্থানগুলোতে ইরাকি বাহিনীর রাসায়নিক হামলা বেড়ে যায়। যুদ্ধের আট বছরে ইরানের অভ্যন্তরে ইরাকি বাহিনী অন্তত ৩০টি রাসায়নিক হামলা চালায়।
১৯৮০’র দশকে ইরাকের হাতে থাকা রাসায়নিক অস্ত্রের শতকরা ৪৮ ভাগ কাঁচামাল আসে হল্যান্ড থেকে। ডাচ ব্যবসায়ী ফ্রান্স ভ্যান অ্যানরাত এসব অস্ত্র বাগদাদের কাছে তুলে দেয়। সাদ্দামের পতনে পর হল্যান্ডের একটি আদালত হালাবজা শহরে হামলার কাজে ইরাকের হাতে রাসায়নিক অস্ত্র তুলে দেয়ার অপরাধে অ্যানরাতকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেয়। তবে এক ব্যক্তিকে শাস্তি দিয়ে কার্যত হল্যান্ডের আদালত ইরাকের শাসক সাদ্দামের হাতে ভয়াবহ রাসায়নিক অস্ত্র তুলে দেয়ার অপরাধ থেকে ইউরোপীয় সরকারগুলোকে নিরপরাধ ঘোষণা করে। অথচ আমেরিকা, ফ্রান্স ও হল্যান্ডসহ পশ্চিমা দেশগুলো ইরাকের হাতে রাসায়নিক অস্ত্র তুলে দিয়ে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পারে না।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /১০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।