ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২২ ১৮:১৯ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পাশ্চাত্যে খাদ্যাভাস বিশেষকরে সেদেশের খাদ্য শিল্পের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ফাস্ট ফুডের মতো খাবারের চাহিদা অনেক বেশি।

ফাস্ট ফুড খাওয়ার পর মাদকাসক্তির মতোই মানুষের মস্তিষ্ক এ ধরণের খাদ্যে আসক্ত হয়ে পড়ে। এর কারণ হলো ফাস্ট ফুড তৈরিতে প্রচুর পরিমাণ চর্বি, চিনি, লবণ ও আজিনোমোটো নামের এক ধরণের উপাদান ব্যবহার করা হয়। এর ফলে বারবার ফাস্ট ফুড খাওয়ার ইচ্ছা জাগে। আজকের আসরে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করব।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সুবাদে গোটা বিশ্বেই চিকিৎসাসেবায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। উন্নত যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সরঞ্জাম রোগ নির্ণয় ও অস্ত্রোপচারকে অনেক সহজ করে তুলেছে। এর ফলে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থাও বেড়েছে। বিশ্বে ২০ হাজার প্রকারের বেশি ওষুধ রয়েছে। বলা হচ্ছে বিশ্বে অর্থ উপাজর্নের তৃতীয় বৃহত্তম খাত হচ্ছে এই‌ ওষুধ শিল্প। ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযাযী ওষুধ শিল্পে বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ ১১ লক্ষ কোটি ডলারের বেশি। বিশ্বে ওষুধের ব্যবসায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকার পাশাপাশি অন্যান্য ধনী দেশগুলোও এ ক্ষেত্রে অগ্রগামী। আন্তর্জাতিক ওষুধ বাজারে ৮০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ এসব দেশের হাতে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশি বাজারের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ আমেরিকার। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা থেকে এখনও অনেকেই বঞ্চিত। অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকের পক্ষেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা গ্রহণ সম্ভব হয় না।

২০১৮ সালের জুনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি খবর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা খরচ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আমেরিকার বোস্টন শহরের একটি রেল স্টেশনে ৪৫ বছর বয়সী এক নারী দুর্ঘটনার শিকার হন। ট্রেন থেকে নামার সময় তার পা ট্রেন আর প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে আটকে যায়। এতে তার পায়ে মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং হাড় বের হয়ে আসে। এ সময় তিনি প্রচণ্ড ব্যথায় কাঁদছিলেন। তিনি যে শুধু পায়ের ব্যথাতেই কাঁদছিলেন তা নয়। আশেপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ডাকার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তখন ঐ নারী তাদের বাধা দিযে বলেন, এ কাজ যেন কেউ না করে। অ্যাম্বুলেন্সের অনেক খরচ। অ্যাম্বলেন্সে করে হাসপাতালে যাওয়ার খরচ বহন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রচণ্ড ব্যথার মাঝে তার এই আকুতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। প্রশ্ন ওঠে মার্কিন চিকিৎসা ব্যবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত খরচ নিয়ে। নিউ ইয়র্ক টাইমস তখনি এ ঘটনা নিয়ে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থা জটিল এবং ব্যয়বহুল। সেখানে স্বাস্থ্যখাতকেও মানব কল্যাণের চেয়ে মুনাফা লাভের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। স্বাস্থ্য বীমা নিয়েও চলে ব্যাপক ব্যবসা। বীমা ব্যবসা লাভজনক হওয়ার কারণে কয়েক দশক আগে অনেক বড় বড় কোম্পানি এই খাতে বিনিয়োগ করে। যদিও এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোটি কোটি নাগরিকের স্বাস্থ্য বীমা নেই। অবশ্য যাদের বীমা রয়েছে তাদেরও একটা বড় অংশ অন্যান্য ধনী দেশের পর্যায়ের ভালো মানের চিকিৎসাসেবা পান না। আমেরিকায় চিকিৎসা খাতে বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করা হলেও বাস্তবে এ ক্ষেত্রে মানুষের সন্তুষ্টির মাত্রা খুব বেশি নয়। সন্তুষ্টির মাত্রা ক্রমেই নিম্নমুখী হচ্ছে। আমেরিকায় স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে মাথাপিছু বার্ষিক ব্যয় প্রায় নয় হাজার ডলার যা অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা ওইসিডি'র অন্য সব সদস্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি। ২০১৭ সালে পরিচালিত এক জনমত জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন প্রায় সব মার্কিন নাগরিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিটি নির্বাচনের আগে এই বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলই নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে নানা প্রতিশ্রুতি দেন। 

২০১৮ সালের মার্চে ‘জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন’ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। হার্ভার্ড টি এইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথ, দ্য হার্ভার্ড গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউট এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের আন্তর্জাতিক তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আরো দশটি ধনী দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার তুলনা করে। এতে দেখা যায়, অন্যান্য দেশের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসা খাতে ব্যয় অনেক বেশি। কিন্তু এরপরও তাদের চিকিৎসার ফলাফল অন্যদের তুলনায় খারাপ, এমনকি অন্য ধনী দেশগুলোর তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের চিকিৎসা নেয়ার প্রবণতাও অনেক কম। টিকাসহ এ ধরণের নানা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়নেও মার্কিন চিকিৎসা খাতে রয়েছে অনেক দুর্বলতা। এ কারণে আমেরিকায় প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে আমেরিকায় ৬১ হাজার মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন বা সিডিসি'র এক প্রতিবেদনেও এ কথা স্বীকার করে বলা হয়েছ, প্রতি বছরই বিপুল সংখ্যক মার্কিন নাগরিক ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণে মারা যান। যদিও ইনফ্লুয়েঞ্জার ভালো মানের টিকা রয়েছে।

জন হপকিন্স কলেজের একদল গবেষকের তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকায় প্রতি বছর প্রায় আড়াই লাখের বেশি মানুষ ভুল চিকিৎসায় মারা যায়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এটিই সত্যি। অন্যান্য প্রতিবেদন অনুযায়ী এ সংখ্যা চার লাখেরও বেশি। হৃদরোগ ও ক্যানসারে ভুল চিকিৎসার জন্য মৃত্যু হার সবচেয়ে বেশি। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা ও আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকার পরেও ভুল চিকিৎসার সংখ্যা এত বেশি হওয়ার পেছনে গবেষকেরা ভুল রোগ নির্ণয়, কম্পিউটার সিস্টেমে ভুল, যন্ত্রপাতির ত্রুটি, সঠিক নিয়মে ওষুধ গ্রহণ না করা এবং চিকিৎসকদের ভুলকেই দায়ী বলে মনে করছেন। #

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ