ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২২ ১৮:৪৭ Asia/Dhaka

আশাকরি আপনারা সবাই ভালো আছেন। গত আসরে আমরা বলেছি, জন হপকিন্স কলেজের একদল গবেষকের তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকায় প্রতি বছর প্রায় আড়াই লাখের বেশি মানুষ ভুল চিকিৎসায় মারা যায়।

অন্যান্য প্রতিবেদন অনুযায়ী এ সংখ্যা চার লাখেরও বেশি। হৃদরোগ ও ক্যান্সারে ভুল চিকিৎসার জন্য মৃত্যু হার সবচেয়ে বেশি। আজকের আসরে আমরা আমেরিকার স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে আরও আলোচনা করব।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে ব্যয় করা হয় প্রায় চার লাখ কোটি ডলার। দেশটির বার্ষিক মোট ব্যয়ের প্রায় ১৭ শতাংশই ব্যয় হয় এই খাতে। ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নামে একটি সংগঠন জানিয়েছে, পৃথিবীর আর কোন দেশে চিকিৎসা খাতে আমেরিকার চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করা হয় না। ২০১৮ সালে চিকিৎসা খাতে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়েছে তার প্রায় ৫৯ শতাংশ ব্যয় করা হয় বিভিন্ন হাসপাতাল, চিকিৎসক এবং ক্লিনিক্যাল সেবা খাতে।
ন্যাশনাল হেলথ এক্সপেনডিচার থেকে প্রকাশিত ২০১৮ সালের এক তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকায় প্রত্যেক নাগরিকের পেছনে চিকিৎসার জন্য গড়ে প্রায় ১০ হাজার ২২৪ ডলার ব্যয় করা হয়। অন্যান্য উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করলে যা অনেক বেশি। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সুইজারল্যান্ডে ব্যয় করা হয় প্রায় ৮ হাজার ৯ ডলার। এরপর যথাক্রমে জার্মানিতে ৫ হাজার ৭২৮ ডলার, সুইডেনে ৫ হাজার ৫১১ ডলার, অস্ট্রিয়াতে ৫ হাজার ৫৪০ ডলার ব্যয় করা হয়। অন্যান্য উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করলে এই খাতে আমেরিকার মাথাপিছু ব্যয় অনেক বেশি।

অস্ত্রোপচার ও রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষাগুলোও অন্যান্য দেশের তুলনায় আমেরিকায় ব্যয়বহুল। ২০১৩ সালে হৃৎপিণ্ডের বাইপাস সার্জারির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে খরচ হতো ৭৫ হাজার ৩৪৫ ডলার। অন্যদিকে, নেদারল্যান্ডস এই খরচ ছিল ১৫ হাজার ৭৪২ ডলার। আর সুইজারল্যান্ডে এই খরচ ছিলো ৩৬ হাজার ৫০৯ মার্কিন ডলার। এমআরআই করতে যুক্তরাষ্ট্রে খরচ হতো ১ হাজার ১৪৫ মার্কিন ডলার, অস্ট্রেলিয়ায় যা ৩৫০ মার্কিন ডলার। কিন্তু আমেরিকায় চিকিৎসা খাতে ব্যয় অনুযায়ী সবচেয়ে মান সম্পন্ন সেবা পায় না জনগণ। সেখানে শিশু মৃত্যুর হারও অনেক বেশি। ২০১৯ সালে আমেরিকায় শিশু মৃত্যুর হার ছিল প্রায় ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যান্য উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করলে এই হার অনেক বেশি। ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকানদের সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল ৭৮ দশমিক ৭ বছর, যা অন্যান্য উন্নত দেশ থেকে কম। এছাড়া আমেরিকায় স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রেও বর্ণ বৈষম্য রয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গ অনেক ক্ষেত্রেই বঞ্চিত, যদিও আমেরিকায় প্রায় ৪ কোটি কৃষ্ণাজ্ঞ মানুষ রয়েছেন যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ।

২০১৬ সালে পিউ গবেষণা সংস্থা পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকায় একেকটি শেতাঙ্গ পরিবারের গড় বার্ষিক আয় এক লাখ ৭১ হাজার ডলার। এর বিপরীতে কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের গড় বার্ষিক আয় মাত্র ১৭ হাজার ডলার। অর্থাৎ গড়ে একটি শেতাঙ্গ পরিবার কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের চেয়ে ১০ গুণ বেশি আয় করে। এই পরিসংখ্যান মার্কিন সমাজে কৃষ্ণাঙ্গ ও শেতাঙ্গদের মধ্যে ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রমাণ বহন করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডাব্লিউএইচও এর আগে জানিয়েছে, সাধারণভাবে কোনো দেশ ও সমাজের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা অপ্রতুল হওয়ার কারণ হলো দারিদ্র। আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা নিম্ন মানের হওয়ার পেছনেও রয়েছে তাদের দারিদ্র। আমেরিকার স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাত সম্পর্কে সমালোচনার আরেকটি বড় কারণ হলো ওষুধের চড়া মূল্য। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমেরিকায় ওষুধের দাম বেশি। আমেরিকায় পেটের পীড়ার ওষুধ নেকসিয়ামের দাম সুইজারল্যান্ডের তিন গুণ।  

আমেরিকায় ওষুধের চড়া মূল্যের একটি কারণ হলো ওষুধ ও বীমা কোম্পানিগুলোর বাড়তি মুনাফা। চিকিৎসা খাতে ব্যয় করা অর্থ শুধু যে জনসাধারণের চিকিৎসার পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে এমন নয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, আমেরিকায় স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে যে অর্থ ব্যয় হয় তার এক-তৃতীয়াংশই এমন কাজে ব্যয় করা হয় যা চিকিৎসার মান উন্নয়নে সরাসরি কোনো প্রভাব রাখে না। আমেরিকায় গড়ে প্রতি তিন জন চিকিৎসকের দাপ্তরিক কাজের জন্য নিযুক্ত আছেন দুই জন করে কর্মচারী। আসলে সরাসরি মানুষের চিকিৎসার পেছনে ব্যয়ের চেয়ে এ সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক কাজ ও জিনিসেই বেশি অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। এই খাতের অর্ধেকেরও বেশি অর্থ খরচ হয়ে যায় হাসপাতাল নির্মাণ, হাসপাতাল উন্নয়ন, ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত কর্মীদের বেতন পরিশোধ করতে। এ ছাড়া বিভিন্ন ওষুধের দাম বাড়ার কারণেও এ খাতে খরচ বাড়ছে। আবার অনেক সময় দেখা যায় হাসপাতালের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির রক্ষনাবেক্ষন খাতে ব্যয় করা হয় অনেক বেশি।

আমেরিকায় বিনামূল্যে চিকিৎসা বলে কোনো শব্দাবলীর অস্তিত্ব নেই। সরকারি হাসপাতালেও যেকোনো চিকিৎসা সেবার জন্য রোগীকে সরাসরি অথবা বীমা কোম্পানির মাধ্যমে পুরো অর্থ পরিশোধ করতে হয়। আমেরিকায় অর্থনৈতিক দেওয়ালিত্বের অর্ধেকের বেশি ঘটনা চিকিৎসা ব্যয় সংশ্লিষ্ট। চিকিৎসা ব্যয় সংক্রান্ত কারণে প্রতি মিনিটে গড়ে দুই জন নাগরিক দেউলিয়া হন। ২০১০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে দেশটির আইনসভায় সাশ্রয়ী মূল্যে চিকিৎসা সেবা সংক্রান্ত বিল অনুমোদিত হয় যা ওবামাকেয়ার নামে পরিচিত। এই আইন অনুযায়ী আরও বেশি মার্কিন নাগরিককে চিকিৎসা বীমার আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এরপরও ওবামার মেয়াদ শেষে এ ক্ষেত্রে আমেরিকার অবস্থান অন্য সব উন্নত দেশের চেয়ে পেছনে ছিল।

২০০৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে চিকিৎসা বীমার ব্যয় নিয়োগকর্তাদের জন্য ৫২ শতাংশ এবং কর্মচারীদের জন্য ৭৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। আমেরিকার জনগণনা দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই সময় মানুষের আয় বাড়েনি বরং ৮ শতাংশ কমেছে। দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর প্রায় চার লাখ শিশুর স্বাস্থ্য বীমার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। পত্রিকাটি আরও লিখেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের বাজেটের কারণে দেশ ছোঁয়াচে রোগ মোকাবেলার ক্ষেত্রে ঝুঁকিতে পড়েছে। করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় ব্যর্থতার পেছনেও এ ধরণের ধ্বংসাত্মক নীতি দায়ী।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ