সূরা ফাতহ : আয়াত ১৪-১৬ (পর্ব-৪)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা ফাতহ 'র ৪নং পর্ব নিয়ে আলোচনা। আজ আমরা এই সূরার ১৪ থেকে ১৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। এই সূরার ১৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَلِلَّهِ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۚ يَغۡفِرُ لِمَن يَشَآءُ وَيُعَذِّبُ مَن يَشَآءُۚ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورٗا رَّحِيمٗا (14)
“আসমানসমূহ ও যমীনের সর্বময় কর্তৃত্ব আল্লাহরই, তিনি যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছে শাস্তি দেন। আর আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (৪৮:১৪)
গত আসরে সেইসব মুনাফিক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে যারা অন্তরে ছিল কাফির কিন্তু বাহ্যিকভাবে নিজেদেরকে মুসলমান হিসেবে তুলে ধরত। এরপর এই আয়াতে বলা হচ্ছে: অবশ্য আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। যে কেউ তার অতীত কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে তওবা করে তিনি তাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু যারা নিজেদের মন্দ কর্মে অটল থাকে এবং আল্লাহর নির্দেশের সামনে গোয়ার্তুমি ও হঠকারিতা দেখায় তারা নিজেদেরকে এই ক্ষমার গণ্ডি থেকে বের করে নেয়। তাদেরকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। এই আয়াতে গোটা বিশ্বজগতের ওপর আল্লাহর একচ্ছত্র সার্বভৌমত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এটি এ কারণে যে, কেউ যেন একথা না ভাবে যে, তার পক্ষে আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্বের গণ্ডির বাইরে চলে যাওয়া সম্ভব।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- আল্লাহ তায়ালার রহমত ও দয়া তাঁর ক্রোধের ওপর প্রাধান্য পায়। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ মন্দ কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত থেকে নিজেকে বঞ্চিত না করে ততক্ষণ পর্যন্ত সে এই দয়ার অন্তর্ভুক্ত থাকে।
২- মানুষের পরকালীন মুক্তির জন্য ভয় ও আশা এই দু’টি বিষয়কে পাশাপাশি রাখতে হবে। একদিকে আল্লাহর ক্রোধের ভয় থাকতে হবে এবং অন্যদিকে তাঁর রহমত ও ক্ষমা লাভ করার আশা বুকে পোষণ করতে হবে।
সূরা ফাতহ ১৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
سَيَقُولُ ٱلۡمُخَلَّفُونَ إِذَا ٱنطَلَقۡتُمۡ إِلَىٰ مَغَانِمَ لِتَأۡخُذُوهَا ذَرُونَا نَتَّبِعۡكُمۡۖ يُرِيدُونَ أَن يُبَدِّلُواْ كَلَٰمَ ٱللَّهِۚ قُل لَّن تَتَّبِعُونَا كَذَٰلِكُمۡ قَالَ ٱللَّهُ مِن قَبۡلُۖ فَسَيَقُولُونَ بَلۡ تَحۡسُدُونَنَاۚ بَلۡ كَانُواْ لَا يَفۡقَهُونَ إِلَّا قَلِيلٗا (15)
“তোমরা যখন যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সংগ্রহের জন্য [খায়বারে] যাবে, তখন [হুদায়বিয়ার যুদ্ধ হতে] পশ্চাতে থাকা লোকেরা বলবে, ‘আমাদেরকেও তোমাদের সাথে যেতে দাও।’ তারা আল্লাহর বাণী [অর্থাৎ হুদায়বিয়ায় না যাওয়া ব্যক্তিদের পরবর্তী যুদ্ধলব্ধ মাল থেকে বঞ্চিত রাখার নির্দেশে] পরিবর্তন করতে চায়। [আপনি তাদেরকে] বলুন, ‘তোমরা কিছুতেই আমাদের সঙ্গী হতে পারবে না।’ আল্লাহ পূর্বেই এরূপ বলে রেখেছেন। সুতারং তারা শিঘ্রই বলবে, [আল্লাহ আমাদেরকে বিরত থাকতে বলেনি] ‘বরং তোমরা তো আমাদের প্রতি হিংসা করছ।’ [এ রকমটি নয়!] বস্তুতঃ তাদের বোধশক্তি সামান্য।” (৪৮:১৫)
মুনাফিকদের অন্যতম চরিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সুযোগের সন্ধান করা। এ ধরনের মানুষ সব সময় দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বাঁচলেও যেখানে স্বার্থের নামগন্ধ পাওয়া যায় সেখানে গিয়ে হাজির হয়।
হুদায়বিয়া থেকে ফিরে আসার পর আল্লাহ তায়ালা মুসলমানরকে খায়বার বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছিলেন এবং এই যুদ্ধে তাদেরকে অংশগ্রহণের অনমুতি দেননি যারা হুদায়বিয়ায় যাওয়ার ব্যাপারে রাসূলের নিদেশ অমান্য করে নিজেদের ঘরবাড়িতে থেকে গিয়েছিল। কিন্তু যখন মুসলমানরা খায়বারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল তখন এসব লোক অতীত ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার অজুহাত তুলে এ যাত্রায় মুসলমানদের সফরসঙ্গী হওয়ার ও গনিমতের মাল বা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু নবীজী এ সময় আল্লাহর নির্দেশের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদেরকে খায়বারে না আসার নির্দেশ দেন।
বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, এই সুযোগ সন্ধানী লোকগুলো নিজেদের অপরাধ স্বীকার করার পরিবর্তে উল্টো অন্যের কাঁধে দোষ চাপানোর চেষ্টা করে। তারা বলে, তোমরা আসলে হিংসার কারণে আমাদেরকে যুদ্ধে নিতে চাও না; কারণ, তোমরা গনিমতের মাল নিজেদের মধ্যে বন্টন করতে চাও।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- কঠিন দুঃসময়ে যারা নিজেদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করে না তাদেরকে কিছু সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখতে হবে যাতে এ ধরনের সুযোগ সন্ধানী হওয়া থেকে অন্যরা বিরত থাকে।
২- সব মুসলমান ঈমানদারিত্ব ও আল্লাহর নির্দেশ পালনের দাবি করে। কিন্তু কঠিন পরিস্থিতিতেই কেবল মুমিন ও মুনাফিকদের আলাদা করে চেনা যায়।
সূরা ফাতহ ১৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
قُل لِّلۡمُخَلَّفِينَ مِنَ ٱلۡأَعۡرَابِ سَتُدۡعَوۡنَ إِلَىٰ قَوۡمٍ أُوْلِي بَأۡسٖ شَدِيدٖ تُقَٰتِلُونَهُمۡ أَوۡ يُسۡلِمُونَۖ فَإِن تُطِيعُواْ يُؤۡتِكُمُ ٱللَّهُ أَجۡرًا حَسَنٗاۖ وَإِن تَتَوَلَّوۡاْ كَمَا تَوَلَّيۡتُم مِّن قَبۡلُ يُعَذِّبۡكُمۡ عَذَابًا أَلِيمٗا (16)
“যেসব বেদুঈন পিছনে রয়ে গিয়েছিল তাদেরকে বলুন, ‘শিগগিরই তোমাদেরকে ডাকা হবে এক কঠোর যোদ্ধা জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে; তারা আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। অতঃপর তোমরা এ নির্দেশ পালন করলে আল্লাহ্ তোমাদেরকে উত্তম পুরস্কার দান করবেন। আর তোমরা যদি আগের মত পৃষ্ঠ প্রদর্শন কর, তবে তিনি তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন।” (৪৮:১৬)
আগের আয়াতে মুনাফিকদের খায়বার যুদ্ধে অংশগ্রহণের আবেদন প্রত্যাখ্যান করার পর এই আয়াতে বলা হচ্ছে: তোমরা যদি আগের নির্দেশ অমান্য করার কারণে সত্যিই অনুতপ্ত হয়ে থাকো তাহলে এর পরবর্তী যুদ্ধে নিজেদের আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে পারবে। আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে অতীত ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ করে দিয়েছেন। তবে সে যুদ্ধে গনিমতের মালের আশা করো না এবং যুদ্ধলব্ধ মাল পাওয়ার আশায় সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করো না। যদি তা করতে পারো তাহলে তোমরা আল্লাহর রহমত ও তাঁর রাস্তায় জিহাদকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। কিন্তু যদি আগের মতো এবারও পিছুটান দাও এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ অমান্য করো তাহলে তোমাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো:
১- সামাজিক জীবনে অন্যায়কারী ব্যক্তিদেরকে চিরতরে বয়কট করার পরিবর্তে তাদের জন্য ফিরে আসার সুযোগ রাখতে হবে।
২- আমরা যেন কখনও শত্রুকে দুর্বল না ভাবি এবং একথা মনে না করি যে, তাদের বিরুদ্ধে একবার যখন বিজয়ী হয়েছি তখন পরবর্তী যুদ্ধেও বিজয়ী হবো। কারণ, শত্রু পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয় করে পরবর্তী যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারে।
৩- মুসলমানদের সামরিক শক্তি এতটা বেশি হতে হবে যেন শত্রুরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
৪- জিহাদের ময়দানে অংশগ্রহণের একমাত্র লক্ষ্য থাকবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ পালন করা। রাজ্য জয় কিংবা অপরের উপর আধিপত্য বিস্তার জিহাদের উদ্দেশ্য হতে পারবে না।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।