ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২২ ১৭:২৫ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা ফাতহ 'র ৫ম পর্ব নিয়ে আলোচনা। আজ আমরা এই সূরার ১৭ থেকে ২১ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। এই সূরার ১৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

لَّيۡسَ عَلَى ٱلۡأَعۡمَىٰ حَرَجٞ وَلَا عَلَى ٱلۡأَعۡرَجِ حَرَجٞ وَلَا عَلَى ٱلۡمَرِيضِ حَرَجٞۗ وَمَن يُطِعِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ يُدۡخِلۡهُ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُۖ وَمَن يَتَوَلَّ يُعَذِّبۡهُ عَذَابًا أَلِيمٗا (17)

“অন্ধের জন্য, খোঁড়ার জন্য ও রোগীর জন্য [যুদ্ধে না গেলেও] কোন অপরাধ নেই। আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করবে, [আল্লাহ] তাঁকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার [গাছপালার] তলদেশে নদীমালা প্রবাহিত; কিন্তু যে ব্যক্তি পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করবে, তিনি তাকে বেদনায়ক শাস্তি দেবেন।” (৪৮:১৭)

আগের আয়াতগুলোতে জিহাদে গমনে অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের ভর্ৎসনা করা হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ ছিল যারা ছিল প্রতিবন্ধী ও অসুস্থ। তাদের পক্ষে জিহাদে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাদের কেউ কেউ রাসূলুল্লাহ (সা.)’র কাছে এসে নিজেদের অক্ষমতা বর্ণনা করার পর এই আয়াত নাজিল হয়। এখানে আল্লাহ বলছেন, যারা সম্পূর্ণ সুস্থ থাকার পরও যুদ্ধে যায়নি তাদের সঙ্গে অসুস্থ ও প্রতিবন্ধী মানুষদের পার্থক্য রয়েছে। অসুস্থদের জিহাদে যাওয়ার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না। [সূরা বাকারা, আয়াত ২৮৬]।

ফরজ নামাজ দাড়িয়ে পড়া ওয়াজিব হলেও অসুস্থ ব্যক্তিদের বসে বসে এমনকি শুয়ে শুয়ে পড়ারও অনুমতি রয়েছে। রমজান মাসের রোজা পালন থেকেও অসুস্থ ব্যক্তিদের মুক্তি দেয়া হয়েছে। এমনকি কেউ যদি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয় যে, রোজা রাখলে সে অসুস্থ হয়ে পড়বে তাহলে তারও রোজা রাখা বাধ্যতামূলক নয়। হজ্ব করার জন্য আর্থিক সামর্থ্যের পাশাপাশি শারীরিক সক্ষমতাও জরুরি। মক্কা সফরের ধকল এবং হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা পালন করার মতো শারীরিক সামর্থ্য না থাকলে হজ্ব করাও ফরজ নয়। আজকের আলোচ্য আয়াতেও বলা হচ্ছে: যাদের যুদ্ধ করার ও আত্মরক্ষা করার মতো শারিরীক সক্ষমতা রয়েছে তাদের ওপরই কেবল জিহাদ করা ফরজ। কিন্তু প্রতিবন্ধী বা অসুস্থ মানুষকে এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- অসুস্থ ও প্রতিবন্ধীদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন এবং তাদেরকে কিছু কিছু বাধ্যতামূলক ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্ব পালন থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। যারা দেশের জন্য আইন প্রণয়ন করেন তাদেরও উচিত এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা।

২- যেকোনো বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশের সামনে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে হবে।

সূরা ফাতহ ১৮ ও ১৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

۞لَّقَدۡ رَضِيَ ٱللَّهُ عَنِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ إِذۡ يُبَايِعُونَكَ تَحۡتَ ٱلشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمۡ فَأَنزَلَ ٱلسَّكِينَةَ عَلَيۡهِمۡ وَأَثَٰبَهُمۡ فَتۡحٗا قَرِيبٗا (18) وَمَغَانِمَ كَثِيرَةٗ يَأۡخُذُونَهَاۗ وَكَانَ ٱللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمٗا (19)

“নিঃসন্দেহে আল্লাহ মুমিনগণের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা [হুদায়বিয়ায়] গাছের নীচে আপনার কাছে বাই’আত গ্ৰহণ করেছিল, অতঃপর তাদের অন্তরে [ঈমান ও সততা সম্পর্কে] যা ছিল তা তিনি জেনে নিয়েছেন; ফলে তিনি তাদের উপর প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে [খায়বারের] আসন্ন বিজয়ে পুরস্কৃত করলেন।”  (৪৮:১৮)

“আর [পুরস্কৃত করলেন] বিপুল পরিমাণ গনিমতের মাল দিয়ে যা তারা [খায়বারে] হস্তগত করবে; আর আল্লাহ হলেন মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।”  (৪৮:১৯)

গত দুই আসরে আমরা বলেছি, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও মুসলমানদের একটি দল ওমরাহ করার উদ্দেশে মদীনা থেকে মক্কায় যান। মক্কার কাছাকাছি পৌঁছে আল্লাহর রাসূল তাঁর একজন সাহাবীকে মক্কার কাফির অধিপতিদের এই বার্তা দিয়ে পাঠান যে, তারা যুদ্ধ করতে আসেননি বরং ওমরাহ পালন করেই মদীনায় ফিরে যাবেন। কিন্তু কাফির নেতারা রাসূলের ওই সাহাবীকে বন্দি করে। এদিকে, হুদায়বিয়ায় মুসলমানদের কাছে গুজব পৌঁছে যায় যে ওই সাহাবীকে হত্যা করা হয়েছে। এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি গাছের নীচে সবাইকে একত্রিত করেন এবং তাদের কাছ থেকে এই বায়াত গ্রহণ করেন যে, তারা কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পিছ-পা হবেন না এবং কেউ যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাবেন না। মুসলমানদের এই বায়াতের খবর কাফিরদের কাছে পৌঁছার পর তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং রাসূলের প্রতিনিধিকে মুক্ত করে দেয়। হুদায়বিয়ায় কাফিরদের সঙ্গে মুসলমানদের এক সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে পরবর্তী বছরগুলোতে মুসলমানদের ওমরাহ করার পথ উন্মুক্ত হয়। আর এর জের ধরে পরবর্তীতে খায়বার বিজয় হয় এবং মুসলমানরা বিপুল পরিমাণ গনিমতের মাল হস্তগত করেন।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- নামাজ ও রোজার মতো কিছু দ্বীনি দায়িত্ব পালনের মধ্যে ঈমান সীমাবদ্ধ নয়; বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের দায়িত্ব পালনে ধর্মীয় নেতাদের সমর্থন ও সহযোগিতা করাও ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

২- কারো বাহ্যিক আমল দেখে তার ঈমান পরিমাপ করা সম্ভব নয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের অন্তরের নিয়ত বা মনোবাসনা সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত এবং তারই ভিত্তিতে তিনি আমাদেরকে পুরস্কৃত করবেন।

৩- আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন একটি আত্মিক বিষয় হলেও গনিমতের মালসহ অন্যান্য দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিলের সঙ্গে এটির কোনো সাংঘর্ষিক অবস্থান নেই।

৪- আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য ও শত্রুদের বিরুদ্ধে তাঁকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর দয়া ও রহমত লাভ করা যায়।

সূরা ফাতহ  ২০ ও ২১  নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَعَدَكُمُ ٱللَّهُ مَغَانِمَ كَثِيرَةٗ تَأۡخُذُونَهَا فَعَجَّلَ لَكُمۡ هَٰذِهِۦ وَكَفَّ أَيۡدِيَ ٱلنَّاسِ عَنكُمۡ وَلِتَكُونَ ءَايَةٗ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ وَيَهۡدِيَكُمۡ صِرَٰطٗا مُّسۡتَقِيمٗا (20) وَأُخۡرَىٰ لَمۡ تَقۡدِرُواْ عَلَيۡهَا قَدۡ أَحَاطَ ٱللَّهُ بِهَاۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٗا (21)

“আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন গনিমতের বিপুল সম্পদের, যার অধিকারী তোমরা হবে। অতঃপর তিনি এটা [অর্থাৎ খায়বারের গনিমত] তোমাদের জন্য তরান্বিত করেছেন। আর তিনি তোমাদের থেকে [আগ্রাসী] মানুষের হাত নিবারিত করেছেন যেন এটা হয় মুমিনদের জন্য [দ্বীনের যথার্থতা ও আল্লাহর সাহায্যের] এক নিদর্শন। আর তিনি তোমাদেরকে পরিচালিত করেন সরল পথে।” (৪৮:২০)

“এবং [তিনি] আরো [বহু বিজয় ও গনিমতের] সম্পদ [তোমাদেরকে দেবেন] যা এখনো তোমরা অধিকারভুক্ত করতে পারনি, কিন্তু তা আল্লাহর আয়ত্তে আছে। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।” (৪৮:২১)

আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: মুমিনদের প্রতি আল্লাহর দয়া হুদায়বিয়ার সন্ধি কিংবা খায়বার বিজয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং মুসলমানরা ভবিষ্যতে এমন আরো অনেক বিজয় অর্জন করবে যেগুলোতে বিজয়ের কথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। কারণ, আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি দানের পাশাপাশি কাফিরদের অন্তরে ভয় ও আতঙ্ক ঢুকিয়ে দেন যাতে তারা আগ্রাসন ও সীমালঙ্ঘন বন্ধ করতে বাধ্য হয়। স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহর এই সাহায্য মুমিনদের ঈমান শক্তিশালী করে, রাসূলের প্রতি তাদের ঈমান মজবুত হয় এবং সত্য পথে অটল থাকতে তাদের সহায়তা করে।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- যুদ্ধের ময়দানে শত্রুপক্ষের কাছ থেকে অর্জিত সম্পদ ও গনিমতের মাল গ্রহণ করা বৈধ এবং যুদ্ধের এই আইনকে আল্লাহ বৈধতা দিয়েছেন।

২- আল্লাহ আমাদেরকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, আমরা যদি তাঁর দ্বীনকে সাহায্য করি তাহলে তিনি পার্থিব জীবনেই আমাদের বৈষয়িক স্বার্থ সমুন্নত রাখবেন।

৩- মুসলমানদের মোকাবিলায় শত্রুর অক্ষম হয়ে পড়া এবং মুসলিম সমাজে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হওয়া আল্লাহ তায়ালার অনেক বড় অনুগ্রহ। আল্লাহ বিষয়টি মুমিনদেরকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।