ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২২ ১৭:৪৮ Asia/Dhaka
  • আফগানিস্তানে দায়েশ জঙ্গি
    আফগানিস্তানে দায়েশ জঙ্গি

আফগানিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ সুন্নি এবং এদের মধ্যে হানাফি মাজহাব অনুসারীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রায় শতভাগ সুন্নি হানাফি হলেও তাদের বিরোধী মতাদর্শের মানুষও সেখানে আছে। অনেকেই হাম্বলি মাজহাব ও সালাফি আকিদা বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত। আবার অনেকে হানাফি মাজহাবের অনুসারী হলেও তারা উগ্র ওয়াহাবি সালাফি মতাদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

ইতিহাস বলছে তাজিকিস্তানের সামারকান্দের শিক্ষা ও সংস্কৃতির সাথে আফগানিস্তানের সম্পর্ক ছিল। সমরকান্দের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ভারসাম্যপূর্ণ এবং উচ্চ সাংস্কৃতিক মর্যাদা সম্পন্ন ছিল এবং কোনো ধরনের উগ্রতা বা বিকৃতির অস্তিত্ব সেখানে ছিল না।

ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী আমিরি বলেছেন, 'বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক আমিরি'র মতে: ঐতিহ্যগতভাবে সমরকন্দের সঙ্গে আফগানিস্তানের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সামঞ্জস্য অনস্বীকার্য। কিন্তু পরবর্তীকালে মধ্য এশিয়ার সমরকন্দের সাংস্কৃতিক মতাদর্শে 'তাহাবিয়াহ' নামে এক ধরনের চরমপন্থার উদ্ভব ঘটে। ইসলামের আদর্শ ও মূলনীতিসহ ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে আফগানিস্তানের ধর্মীয় চেতনা ও মূল্যবোধের ওপর ওই চরমপন্থী মতাদর্শের প্রভাব সহজেই লক্ষ্যনীয়। মনে রাখতে হবে আফগানিস্তানের ধর্মীয় এই প্রবণতার শেকড় কিন্তু দেওবন্দে প্রোথিত নয়। বরং এর শেকড়মূলে রয়েছে সমরকন্দের সেই তাহাবিয়া মতাদর্শ'।

আফগানিস্তানে উগ্রপন্থা বিস্তারের ইতিহাস জানতে হলে প্রায় একশ' বছর আগে ফিরে যেতে হবে। কেননা প্রায় ১০০ বছর আগে সৌদি উগ্র ওয়াহাবি সালাফি চিন্তাধারার বিস্তার ঘটে এ দেশটিতে। আর এটাও লক্ষ্য করা গেছে বিশ্বের যে অঞ্চলে দরিদ্র মানুষের বসবাস সেখানেই ধর্মের নামে উগ্রতার বিস্তার ঘটেছে। অর্থাৎ উগ্রপন্থীরা দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলকেই টার্গেট করেছে। কারণ দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে উগ্রতার দিকে ঠেলে দেয়া সহজ। উগ্র ওয়াহাবি সালাফি আকিদা বিশ্বাসের সঙ্গে আফগানিস্তানের জনগণের পরিচয় প্রায় ১০০ বছর ধরে। ১৯১২ সালে সৌদি ওয়াহাবি মুফতি শেইখ মোহাম্মদ শারেহ মদিনা শহর থেকে মধ্যএশিয়ার ফারগানে উপত্যকা এলাকায় যান এবং সেখানকার স্থানীয় জনগণের কাছে সালাফি ও ওয়াবাহি আকিদা বিশ্বাস তুলে ধরেন। তিনি বেশ কিছু সংখ্যক অনুসারী পেয়ে যান এবং এরপর তারই অনুসারী বা সমর্থকরা আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় বাদাখশান, কুনার, খোস্ত ও নুরেস্তানের উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় প্রবেশ করে সেখানে সালাফি মতবাদ প্রচারে ভূমিকা রাখে।

উপজাতি অধ্যুষিত এসব পার্বত্য অঞ্চলগুলো ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের পাশেই এবং তৎকালীন সময়ে এ অঞ্চলে আফগান শাসকদের সঙ্গে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তির প্রায়ই যুদ্ধ-বিগ্র হত এবং এর ফলে কখনো কখনো শাসন ক্ষমতায় শূন্যতা দেখা দিত। শুধু আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চল নয় একইসঙ্গে দেশটির ফারা প্রদেশসহ অন্যান্য অঞ্চলেও উগ্র সালাফি মতবাদের বিস্তার ঘটেছিল। এ প্রসঙ্গে ইরানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোল্লা যেহি বলেছেন, ওয়াহাবি সালাফি মতবাদ প্রচারক শেইখ মোহাম্মদ শারেহ আফগানিস্তানের ক্ষমতায় শূন্যতা সৃষ্টির সুযোগে ওই অঞ্চলকে ওয়াহাবি মতবাদের ঘাঁটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। বাদাখশান প্রদেশের আরগু, নুরেস্তান প্রদেশের বার্গ মাথাল এবং কুনার প্রদেশের আরেকটি ক্ষুদ্র স্থানকে উগ্র সালাফি মতবাদ প্রচারের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলা হয়। এখান থেকেই ওয়াহাবি চিন্তাধারা অনুযায়ী ইসলামের মাসলা মাসায়েল বিষয়ক মনগড়া ব্যাখ্যা তুলে ধরা হতো স্থানীয় জনগণের কাছে যা ছিল উগ্রতা ও বিকৃতিতে ভরপুর।

আফগানিস্তানের দরিদ্র শিশুরা

১৯৫০ এর দশক থেকে এসব ছোট ছোট অঞ্চলে তৎপরতা শুরু করেছিল ওয়াহাবি সালাফিরা। তবে এসব অঞ্চল ছিল মূল অধিবাসীদের থেকে অনেক দূরে দুর্গম পার্বত্য এলাকায় যাতে তাদের ওপর কারো নজর না পড়ে। কিন্তু সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান দখল এবং তাদের মোকাবেলায় জিহাদি গ্রুপ গড়ে ওঠায় সৌদি ওয়াহাবি সালাফিদের উগ্র ও বিকৃত মতবাদ প্রচারের পথ সুগম হয়। এসময় বহু জিহাদি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় প্রবেশ করলে তারাও সালাফিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়।

১৯৭৮ সালের ২৭ এপ্রিলে আফগানিস্তানে কমিউনিস্টদের অভ্যুত্থানের আগ থেকেই সেদেশে ওয়াবাহি সালাফি মতবাদ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ব্যাপক চেষ্টা চলে। জনগণ অল্প অল্প করে সালাফি মতবাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া শুরু করে কিন্তু তারপরও যেহেতু বেশিরভাগ মানুষ হানাফি মাজহাবের অনুসারী এবং সুন্নি ধর্ম-বিশ্বাস ও  আমল-আকিদার সঙ্গে ওয়াহাবি সালাফি মতবাদের কোনো মিল সেই কারণে জনগণ সালাফিদেরকে ঘৃণা করতো এবং দূরত্ব বজায় রাখতো।

এ থেকে বোঝা যায় আফগান সমাজে উগ্র সালাফি মতবাদের কোনো জায়গা নেই। এ কারণে কমিউনিষ্ট বিপ্লবের আগে কিংবা পরে যারা প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তারা বলেছেন, পূর্বাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াবাহিরা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলেও জনগণ তাদেরকে সেভাবে গ্রহণ করেনি। কারণ নামাজসহ অন্যান্য ধর্মীয় আহকাম বিষয়ে হানাফিদের সঙ্গে সালাফিদের পার্থক্য ছিল। যেমন ওয়াহাবি সালাফিরা নামাজ পড়ারসময় দুই হাত বুকের ওপর বেধে নামাজ পড়ে। কিন্তু হানাফিরা নাভির নীচে কিংবা নাভির ওপরে হাত রেখে নামাজ আদায় করে। এ ছাড়া ওয়াহাবি সালাফিরা নামাজ পড়ার সময় উচ্চস্বরে 'আমিন' বলে। কিন্তু হানাফিরা মনে মনে 'আমিন' উচ্চারণ করে। সালাফিরা নামাজ পড়ার সময় দুই পা ফাঁক করে এমনভাবে দাড়ায় যাতে অন্যের পায়ের সঙ্গে নিজের পায়ের ছোঁয়া লাগে। কিন্তু জাফরি মাজহাবের দ্বারা প্রভাবিত হানাফিরা এ ভাবে নামাজ আদায় করে না। #

পার্সটুডে/এমআরএইচ/

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ