ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (পর্ব-৯৯) : ফাও উপত্যকা হাতছাড়ার কারণ ও আমেরিকার সঙ্গে ইরানের সংঘাত
আজ আমরা ইরানের কাছ থেকে ফাও উপত্যকা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার কারণ ও আমেরিকার সঙ্গে ইরানের মুখোমুখি সংঘাত সম্পর্কে আলোচনা করব।
ইরাকি বাহিনীর সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও বাগদাদের রণকৌশলে পরিবর্তনের কারণেই তাদের পক্ষে ইরানের কাছ থেকে ফাও উপত্যকা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। ইরান ছয় বছর আগে ফাও উপত্যকা দখল করার পর দীর্ঘদিন ইরাকের পক্ষ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিজের সৈন্যদেরকে উত্তরাঞ্চলীয় ফ্রন্টে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ইরাক যখন ফাও পুনরুদ্ধারের অভিযান চালায় তখন ইরানের বেশিরভাগ সৈন্য ওই উপত্যকা থেকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার উত্তরে মোতায়েন ছিল। সেইসঙ্গে ইরাক যে রক্ষণাত্মক রণকৌশল বাদ দিয়ে আক্রমণাত্মক অবস্থানে চলে গিয়েছিল সেটি তেহরান সময়মতো বুঝতে পারেনি।
এ সম্পর্কে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র পদস্থ কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলামআলী রশিদ বলেন, ইরাকি বাহিনীর তৎপরতা দেখে আমরা বুঝতেই পারিনি যে, তাদের কৌশলে পরিবর্তন এসেছে। আমরা তিনটি কারণে ফাও উপত্যকায় পরাভূত হয়েছিলাম। প্রথমত, ১৯৮৬ ও ১৯৮৭ সালে ইরাকি বাহিনী আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ ফ্রন্টে আমাদের ব্যর্থতা এবং সে ব্যর্থতা পুষিয়ে নিতে আমাদের উত্তরাঞ্চলে চলে যাওয়া। আর তৃতীয়ত, শত্রুর রণকৌশলে পরিবর্তন সম্পর্কে আমাদের অন্ধকারে থাকা। এরমধ্যে আমাদের প্রধান সমরশক্তিকে ফাও উপত্যকা থেকে প্রায় ১,০০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ওই উপত্যকা হাতছাড়া হওয়ায় প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে।
মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস পরবর্তীতে এক বিশ্লেষণে জানায়, ফাও উপত্যকায় মোতায়েন ইরানি সেনা কমান্ডাররা একথা ভাবতেই পারেননি যে, ইরানিরা তাদের ওপর হামলা করার সক্ষমতা অর্জন করেছে বা সেরকম হামলা করতে চায়। ইরাকিরা ইরানের এই নির্লিপ্ত মনোভাবের সুযোগ গ্রহণ করে ফাও দ্বীপে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে এটি পুনরুদ্ধার করে। ইরাকি বাহিনীর হাতে ফাও উপত্যকার পতনের পর এ বিষয়ে নানারকম চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে ফাও দ্বীপে ইরাকি বাহিনীকে মোকাবিলা করার মতো পর্যাপ্ত ইরানি সৈন্য মোতায়েন না রাখার কথা বলা হয়েছে।
এদিকে দক্ষিণ ফ্রন্টে ইরান কোনো সফল অভিযান চালানোর সুযোগ না পাওয়ায় উত্তর-পশ্চিম ফ্রন্টে ইরাকের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তিমত্তা প্রদর্শন ছাড়া ইরানের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। এ কারণে ১৯৮৭ সালের শেষদিকে এবং ১৯৮৮ সালের গোঁড়ার দিকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ইরাকের বিরুদ্ধে কয়েকটি ছোট-বড় অভিযান চালায় ইরান।
প্রশ্ন হচ্ছে, ইরান যদি উত্তরাঞ্চলে অভিযান চালাতে না যেত এবং দক্ষিণাঞ্চলে নিজের সামরিক শক্তি অক্ষুণ্ণ রাখত তাহলে কি ইরাকিরা পাল্টা হামলা চালিয়ে ফাও উপত্যকা পুনরুদ্ধার করতে পারত? এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, সে সময় দক্ষিণ ফ্রন্টের বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ইরানের সামনে তিনটি পথ খোলা ছিল। প্রথমত, ইরাকি বাহিনী যেকোনো সময় হামলা করতে পারে ধরে নিয়ে ফাও উপত্যকাসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজের সমরশক্তি অক্ষুণ্ণ রাখা। কিন্তু ইরাকি বাহিনী ঠিক কোন্ স্থানে হামলা চালায় সে সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকায় এরকম বিশাল অঞ্চলে সৈন্য মোতায়েন করে রাখা মোটেই লাভজনক ছিল না। দ্বিতীয়ত, ইরান আশা করেছিল ইরানি যোদ্ধারা যখন উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে হামলা শুরু করবে তখন ইরাকি বাহিনীও তাদের সেনাদের দক্ষিণ থেকে সরিয়ে উত্তরাঞ্চলে মোতায়েন করবে। কিন্তু বাগদাদ সে কাজ করেনি।
ইরানের সামনে তৃতীয় যে পথটি খোলা ছিল তা হলো- জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নিয়ে ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করা। ইরানি যোদ্ধারা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যস্ত ছিলেন তখন ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য এর কয়েকটি ধারায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। ওদিকে এই সময়টিতে ইরাকের প্রতি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা প্রকাশ্য রূপ ধারণ করায় যুদ্ধক্ষেত্রে ইরান আরো কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ইরানের তৎকালীন প্রধান সেনা কমান্ডার হাশেমি রাফসানজানি বলেন, ফাও উপত্যকায় আমাদের সমরশক্তি আরো বেশি থাকলেও এই দ্বীপকে ধরে রাখা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। দ্বীপটির পতন কিছুদিনের জন্য ঠেকিয়ে রাখা যেত মাত্র।
এদিকে ইরাকের হাতে ফাও উপত্যকার পতনের পর আমেরিকা সরাসরি সাদ্দামের পক্ষ নিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৮৮ সালের ১৮ এপ্রিল পারস্য উপসাগরে মোতায়েন মার্কিন যুদ্ধজাহাজ স্যামুয়েল বি রবার্টসের সঙ্গে মাইনের ধাক্কা লাগার অজুহাতে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন বাহিনী সালমান ও নাস্র নামক ইরানের দু’টি তেল স্থাপনা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। ওই ঘটনার তিন ঘণ্টা পর মার্কিন যুদ্ধজাহাজ উইনরাইট ও স্যাম্পসন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইরানের তিনটি যুদ্ধজাহাজ জোশান, সাহান্দ ও সাবালানকে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এ ভয়াবহ হামলায় ইরানের নৌবাহিনীর ৬৪ নাবিক নিহত হন। আমেরিকা শুধু এসব জঘন্য অপকর্ম করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং এরপর ঘোষণা করে, তাদের রণতরীগুলো পারস্য উপসাগরে যাতায়াতকারী সকল জাহাজের নিরাপত্তা দেবে।
এ সময় আমেরিকা নিজের যুদ্ধজাহাজগুলোর লজিস্টিক সাপোর্ট ও জ্বালানী সংগ্রহের জন্য সৌদি আরব ও কুয়েতের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এছাড়া, মার্কিন বিমান বাহিনী সৌদি আরব ও কুয়েতের বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করে পারস্য উপসাগরে ইরানের অবস্থানগুলোতে হামলা চালাত। এরমধ্যে বাহরাইনও তার বিমান ঘাঁটিগুলোকে মার্কিন বাহিনীকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে দেয়। মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলো সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের আকাশসীমা ব্যবহার করে ইরানের ওপর হামলা চালাত এবং মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলো আরব আমিরাতের বিভিন্ন বন্দর থেকে জ্বালানী সংগ্রহ করত। মার্কিন সেনা কমান্ডাররা ইরানের বিরুদ্ধে হামলার কাজে আরব দেশগুলোর এই সহযোগিতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। #
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /০২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।