ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (পর্ব-১০৩) : জাতিসংঘকে ইমাম খোমেনী (রহ.)'র চিঠি
গত আসরে ইরানের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছি। আজ আমরা ওই প্রস্তাব গ্রহণ করে ইমাম খোমেনী (রহ.) জাতিসংঘকে যে চিঠি দিয়েছিলেন সে সম্পর্কে আলোচনা করব।
ইরাকের সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দাম আমেরিকার উসকানি ও মদদে ১৯৮০ সালে ইরানে হামলা করেছিল। যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এই সমর্থন অব্যাহত থাকে। যুদ্ধের শেষের দিকে কোনো রাখঢাক না রেখে আমেরিকা সরাসরি ইরাকের পক্ষে যুদ্ধ করতে নেমে যায়। এ সময় পারস্য উপসাগরে ব্যাপকভাবে মার্কিন যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা বেড়ে যায়। তারা ইরানের সামরিক ও বেসামরিক অবস্থানে হামলা চালাতে থাকে। এমনকি মার্কিন সেনারা ইরানের যাত্রীবাহী বিমান গুলি করে ভূপাতিত করতেও কুণ্ঠিত হয়নি। এরকম পরিস্থিতিতে পারস্য উপসাগরকে পুরোপুরি নিরাপত্তাহীন করে তোলার সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকা। এ সময় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমিয়ে ইরানকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকা। ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সৌদি আরব তেল উত্তোলন বাড়িয়ে দেয়। বিশ্ব বাজারে সৌদি তেল সরবরাহ বেড়ে গেলে আন্তর্জাতিকভাবে তেলের দাম পড়ে যায়।
তেলখাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ করা ইরানের জন্য কঠিন হয়ে যায়। যতই দিন যাচ্ছিল ততই ইরানের তেলখাত থেকে উপার্জন কমে আসছিল এবং ইরানের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ছিল। সরকারের পক্ষে একসঙ্গে দেশ পরিচালনা এবং যুদ্ধের ব্যয় মেটানো সম্ভব হচ্ছিল না। ইরান যেসব কারণে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল তার প্রধান কারণ ছিল এটি। এছাড়া, ইরাকি বাহিনীকে আবার ইরানের ভূমি দখল করতে বাধা দেওয়া এবং ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ওই প্রস্তাব মেনে নেওয়া ছাড়া ইরানের সামনে আর কোনো উপায় ছিল না। ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণ সম্পর্কে দেশের জনগণ ও দায়িত্বশীলদের উদ্দেশ করে যে বাণী দিয়েছিলেন তাতে ওই প্রস্তাব গ্রহণের প্রেক্ষাপট সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। ইমামের বাণীটি শুরু হয়েছিল এভাবে:
আমাদের সেনা অধিনায়করা সুস্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন যে, ইরানের সেনাবাহিনী খুব শিগগিরই যুদ্ধের ময়দানে তেমন কোনো বিজয় অর্জন করতে পারবে না। এছাড়া, সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও আমাকে বলেছেন যে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া দেশের জন্য কোনো অবস্থায় মঙ্গলজনক হবে না। তারা আরো বলেছেন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তি ইরাকি স্বৈরশাসক সাদ্দামের হাতে যে সমরাস্ত্র তুলে দিয়েছে তার ১০ ভাগের এক ভাগ অস্ত্রও আমাদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। পাশাপাশি ইরাকি বাহিনী ব্যাপকভাবে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করতে শুরু করেছে এবং সেই অস্ত্রের প্রভাব প্রতিহত করার কোনো উপায় আমাদের কাছে নেই। এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আমি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নিতে সম্মতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
ইমাম খোমেনী তার এই বাণীতে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র তৎকালীন কমান্ডার মোহসেন রেজায়ির একটি চিঠির প্রতি ইঙ্গিত করেন। ওই চিঠিতে রেজায়ি লিখেছিলেন, আগামী পাঁচ বছরে আমরা কোনো বিজয় অর্জন করতে পারব না। তিনি পাঁচ বছর পর অর্থাৎ ১৯৯৩ সালের মার্চ মাসকে টার্গেট ধরে ইমামকে জানান, ওই সময় নাগাদ আমরা যদি ৩৫০ ব্রিগেড পদাতিক বাহিনী, ২,৫০০ ট্যাংক, ৩,০০০ কামান, ৩০০ যুদ্ধবিমান ও ৩০০ হেলিকপ্টারসহ অন্যান্য সমরাস্ত্র সংগ্রহ করতে পারি তাহলে ওই সময়ের পর আল্লাহ চাইলে আমরা আবার এমন অভিযান চালানোর সক্ষমতা অর্জন করব যাতে বিজয় অর্জন করা সম্ভব হয়। জেনারেল রেজায়ির এই চিঠির প্রতি ইঙ্গিত করে দেশের দায়িত্বশীলদের লক্ষ্য করে ইমাম তার বাণীতে আরো বলেন, আইআরজিসি’র কমান্ডার তার বাহিনীকে সাতগুণ এবং সেনাবাহিনীকে দুই গুণ বড় করার প্রস্তাব করেছেন এবং একথাও বলেছেন যে, এত বিশাল বাজেট সামরিক খাতে বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষমতা হয়তো সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না।
ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা দেশের কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, অর্থমন্ত্রীর বরাত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আমাকে জানিয়েছেন, দেশের প্রতিরক্ষা খাতে চলতি বছর নতুন বাজেট দেয়া সম্ভব হবে না। এদিকে সেনা কমান্ডাররা বলেছেন, সাম্প্রতিক যুদ্ধে যে পরিমাণ অস্ত্র আমাদের হাতছাড়া হয়েছে তার মূল্য আমাদের গত বছরের মোট সামরিক বাজেটের সমান। আপনারা প্রত্যেকে খুব ভালো করে জানেন যে, নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণ করা আমার জন্য বিষপানের সমতুল্য। কিন্তু আমি আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছাকে মাথা পেতে নিচ্ছি এবং ধর্ম ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রস্তাবটি মেনে নিচ্ছি।
ইমাম খোমেনী ছিলেন একইসঙ্গে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা। তাঁর সব আচরণ ও কথাবার্তার উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা। তিনি নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার সাহায্য চান। তিনি বলেন, “হে আল্লাহ! আমরা তোমার দ্বীনের জন্য সংগ্রাম করেছি এবং তোমাদের দ্বীনের জন্য যুদ্ধ করেছি। এখন তোমার দ্বীন রক্ষার উদ্দেশ্যেই যুদ্ধবিরতি মেনে নিচ্ছি। হে আল্লাহ! তুমি নিশ্চয়ই দেখেছো, আমরা আমেরিকা বা সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা বিশ্বের অন্য কোনো শক্তির কাছে এক মুহূর্তের জন্য মাথা নত করিনি। পরাশক্তিগুলোর কাছে মাথানত করাকে তোমার দ্বীনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের সমতুল্য বলে মনে করেছি।”
এভাবে দেশের জনগণকে সার্বিক পরিস্থিতি জানানোর পর জাতিসংঘকে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত দেন ইমাম খোমেনী (রহ.)। তার নির্দেশে ১৯৮৮ সালের ১৮ জুলাই ইরান জাতিসংঘের মহাসচিব পেরেজ ডি-কুইয়ারের কাছে লেখা এক চিঠিতে ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেয়ার কথা ঘোষণা করে। #
র্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /১০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।