মার্চ ১৩, ২০২২ ১৮:১০ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেওয়ার ব্যাপারে জনগণকে উদ্দেশ করে ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর বাণী সম্পর্কে কথা বলেছি। আজকের আসরে আমরা ইরানের পক্ষ থেকে ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেওয়ার পরবর্তী ঘটনাবলী বর্ণনা করব।

ইরান ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেওয়ার পর ইরাকের তৎকালীন শাসক সাদ্দাম বিষয়টিকে ইরানের দুর্বলতা বলে গ্রহণ করেন। তিনি ভাবতে থাকেন এই মোক্ষম সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইরানে আগ্রাসন চালালে যুদ্ধের শুরুর বছরগুলোর মতো ব্যাপক সাফল্য আসবে এবং দেশটির বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড দখল করা যাবে। এ ধারনার বশবর্তী হয়ে সাদ্দাম বাহিনী ইরাক-ইরান সীমান্তের দক্ষিণ ফ্রন্ট থেকে শুরু করে উত্তর ফ্রন্ট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে হামলা শুরু করে। এই খবর পাওয়া মাত্র ইরানি তরুণ ও যুবকেরা সারাদেশ থেকে যুদ্ধ করার জন্য ইরাক সীমান্তের দিকে ছুটে যায়।  ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র দায়িত্ব ছিল গণবাহিনীকে সংগঠিত ও পরিচালিত করা।  কিন্তু এত বেশি মানুষ গণবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করতে আসে যে, আইআরজিসি’র পক্ষে তাদেরকে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

এই বাহিনী গণমাধ্যম থেকে বিশেষ করে রেডিও ও টেলিভিশন থেকে জনতাকে ফ্রন্টে না যেতে অনুরোধ করে এবং যারা এরইমধ্যে চলে গেছে তাদেরকে যুদ্ধের নানা ধরনের কাজে লাগায়। এদিকে ইরাকি বাহিনীর আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য আইআরজিসি নিজে প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তোলে। এসব ঘটনায় যুদ্ধ পরিস্থিতি আবার ইরানের অনুকূলে চলে আসে যা ইরাকি বাহিনীর জন্য ছিল অকল্পনীয়।  ঠিক এ সময়টিতে ইরাকি বাহিনী ইরানের খোররামশাহর ও আহওয়াজ শহর দখল করার জন্য এই দুই শহরের কাছাকাছি অবস্থান করছিল।  এ অবস্থায় ইমাম খোমেনী (রহ.) ফ্রন্টে অবস্থানরত আইআরজিসি’র কমান্ডার মোহসেন রেজায়ির কাছে একটি বার্তা পাঠান। বার্তায় ইমাম বলেন, এবার আর কারো কাছ থেকে কোনো অজুহাত শোনা হবে না। এবারের যুদ্ধে প্রমাণিত হবে যে, আইআরজিসি আবার প্রাণ ফিরে পাবে নাকি জনগণের কাছে একটি পরাজিত ও লাঞ্ছিত বাহিনী হিসেবে চিহ্নিত হবে।

ইমামের এ বার্তার খবর ফ্রন্টের ঘাঁটিগুলোতে পৌঁছে যাওয়ার পর ইরানি যোদ্ধারা প্রাণ ফিরে পান এবং আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে পূর্ণ উদ্যোমে যুদ্ধ করার অনুপ্রেরণা লাভ করেন।  ইরানি যোদ্ধারা দ্বিগুণ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীকে উচিত শিক্ষা দিয়ে দেন। ইরানের পাল্টা হামলায় পর্যুদস্ত ইরাকি বাহিনী বিভিন্ন ফ্রন্টে পশ্চাদপসরণ শুরু করে। ইরাকি টেলিভিশনের নিয়মিত অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে ঘোষণা করা হয়, তাদের সেনারা দক্ষিণাঞ্চলীয় ফ্রন্ট থেকে পিছু হটে গেছে। ইরাকি সেনা মুখপাত্র টেলিভিশনের পর্দায় ঘোষণা করেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে’ হাই কমান্ডের নির্দেশে তাদের সেনাদের সীমান্ত থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

এর অর্থ হচ্ছে, ইরাকি বাহিনী যখন যুদ্ধক্ষেত্রে আবার মার খেতে থাকে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব মেনে না নেওয়ার কারণে চাপের মুখে পড়ে তখন নিজেদের আগ্রাসী মনোভাব পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকের পুনরায় আগ্রাসন এবং এরপর তাদের পিছু হটার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়।  ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি তার বিশ্লেষণে জানায়, ইরানের ওপর সামরিক চাপ সৃষ্টি এবং শান্তি আলোচনায় নিজের শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখার স্বার্থে ইরাক সীমান্ত থেকে নিজের সেনা সরিয়ে নিয়েছে। বাগদাদে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকদের একাংশ সাংবাদিকদের জানান, ইরাক নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার কাজে নিজের নয়া সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে চায়।

জার্মান বার্তা সংস্থা দেশটির গণমাধ্যম উদ্ধৃত করে জানায়, বাগদাদ যেভাবে নিজ ইচ্ছায় যুদ্ধ শুরু করেছিল সেভাবে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী শর্ত চাপিয়ে দিয়ে যুদ্ধ শেষ করতে চায়।  জার্মান পত্রিকা রুন্ড শাও এক বিশ্লেষণে জানায়: “সাদ্দাম মনে করেন তিনি এখন যা খুশি তা-ই ইরানের ওপর চাপিয়ে দিতে পারবেন।”

এদিকে, ইরাক নতুন করে ইরানে আগ্রাসন শুরু করেছিল বলে ইরানি জনগণ ঈমানি বলে বলীয়ান হয়ে আবার আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ সম্পর্ক বিবিসি লন্ডন এক প্রতিবেদনে জানায়, “ইরানে ১৯৮০ সালের শরতের মতো অর্থাৎ ইরানে ইরাকের আগ্রাসনের সময়কার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে। জনগণের মধ্যে আবার যুদ্ধের সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। ইরান সরকারও বিষয়টির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করে যুদ্ধে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে।”

ইরানে ইরাকের পুনঃআগ্রাসন প্রমাণ করে যে, তেহরানের অবস্থান দুর্বল হতে দেখে বাগদাদ আবার যুদ্ধংদেহী হয়ে ওঠে এবং আবার রাষ্ট্র দখলের নেশায় মেতে ওঠে। কিন্তু ইরাকি শাসকের এই ধারনা ভুল প্রমাণিত হতে সময় লাগেনি।  ইরাকি বাহিনী চেয়েছিল ইরানের আরো বেশি ভূখণ্ড দখল করে ইরানি যোদ্ধাদের আরো ক্ষতি করতে। কিন্তু ইমাম খোমেনী এবারও দেশরক্ষার কাজে এগিয়ে আসেন এবং তাঁর একটি বার্তায় যুদ্ধের পট পরিবর্তিত হয়ে যায়।

ইরানের পক্ষ থেকে ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেয়ায় শুধু যে সাদ্দাম সরকার খুশি হয়েছিল তাই নয় ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থা-বিরোধী সন্ত্রাসী মোনাফেকিন গোষ্ঠীও বিষয়টিকে একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে।  রাজাভি ও তার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যরা চরম অবমাননাকর শর্ত মেনে নিয়ে ইরাকে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করে এবং ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

ইরান ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইরাকি শাসক সাদ্দামের সভাপতিত্বে দেশটির সেনা কমান্ডাররা জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। ওই বৈঠকে সন্ত্রাসী মোনাফেকিন গোষ্ঠীর নেতা মাসুদ রাজাভিও অংশ নেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ইরাকি বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় মোনাফেকিন গোষ্ঠীর সন্ত্রাসীরা ইরানে ঢুকে পড়বে এবং তারা তেহরানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে। ওই বৈঠকে সাদ্দামকে রাজাভি বলেন, আপনি এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকুন যে, আমার গোষ্ঠীর লোকেরা মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইরাক সীমান্ত থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে ইরানের হামেদান শহরে প্রবেশ করবে। সাদ্দাম এই অভিযানে সম্মতি দেন এবং বলেন, এবার হয়তো ইরানের বর্তমান সরকারকে ধ্বংস করে দেয়া সম্ভব হবে। মোনাফেকিন গোষ্ঠী সাদ্দামের সহযোগিতায় ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে নিজে ক্ষমতায় বসার বাসনায় ইরানে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নেয়।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /১৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ