রংধনু আসর : নওরোজের গল্প
রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। আসরের শুরুতেই তোমাদেরকে ফার্সি নববর্ষ বা নওরোজের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশিদ এবং আমি আকতার জাহান।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, গত ২১ মার্চ তারিখে ইরানে নওরোজ উৎসব শুরু হয়েছে। নওরোজ হচ্ছে ইরানের একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। ‘এটি ইরানি উৎসব হলেও ভারত উপমহাদেশে বিশেষকরে মোগল আমলে জাঁকজমকের সাথে তা পালিত হতো। এখনও আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তুরস্ক, আযারবাইজান, কুর্দিস্তান এবং কোনো কোনো আরব ও ইউরোপীয় দেশে নওরোজ উৎসব পালন করা হয়ে থাকে।
বন্ধুরা, ফার্সি নববর্ষ ১৪০১ উপলক্ষে আজ আমরা একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। শুরুতেই থাকবে নওরোজ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। এরপর থাকবে নওরোজ ও বসন্ত ঋতু সম্পর্কে একটি ফার্সি, দুটি গল্প এবং একটি বাংলা গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, ফার্সি ‘নওরোজ’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে 'নতুন দিন'। ফার্সি ফারভারদিনের প্রথম দিন নওরোজ। আবার বসন্তের সূচনাও হয় একই দিনে। বসন্ত বরণ এবং নওরোজ উৎসব একত্রেই পালিত হয় ইরানে। নওরোজকে ইরানে ঈদে নওরোজও বলা হয়ে থাকে।
নওরোজ উৎসব বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জন্য শান্তি, মৈত্রী ও সুখ-সমৃদ্ধির বার্তা বয়ে আনে। আর এ কারণেই জাতিসংঘের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২০১০ সালে নওরোজ উৎসবকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে। ওই সংস্থা নওরোজ উৎসবের প্রথম দিনকে 'বিশ্ব নওরোজ উৎসব' হিসেবে ঘোষণা করেছে।
বন্ধুরা, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ‘নওরোজ’ সম্পর্কে বলেছেন, ‘নওরোজ বা নববর্ষ মহান প্রতিপালকের সামনে মানুষের দাসত্ব ও বিনম্রতা প্রকাশের মাধ্যম। নওরোজ হল নব-উদ্ভাবন বা সৃষ্টিশীলতা, সজীবতা, তারুণ্য ও প্রফুল্লতার প্রতীক। একইসঙ্গে এই উৎসব পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও ভাইয়ে-ভাইয়ে হৃদ্যতা, আত্মীয়-স্বজনের পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি, পরিচিতজন ও বন্ধুদের মধ্যে আন্তরিকতা বৃদ্ধি ও হিংসা-বিদ্বেষ দূর করার প্রতীক।’

ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে, কোনো কোনো দেশে নওরোজ উৎসব কেবল একটি প্রাচীন উৎসব মাত্র। ইরানে ইসলাম-পূর্ব যুগেও এই উৎসবের ছিল বেশ কিছু সুন্দর প্রথা ও আনুষ্ঠানিকতা। অবশ্য এর পাশাপাশি কিছু কুসংস্কারও প্রচলিত ছিল। ইরানে ইসলাম আগমনের পর নওরোজের মধ্যে বেশ কিছু মূল্যবান আচার-অনুষ্ঠান যুক্ত হয় এবং এ উৎসব পরিণত হয় আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি ও সন্তুষ্টি অর্জনের এক মোক্ষম সুযোগে।
আয়াতুল্লাহিল উজমা আরও বলেছেন, ‘বর্তমানে নওরোজ ইরানি জাতির জন্য আল্লাহকে স্মরণের মাধ্যম। নতুন বছর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইরানিরা আল্লাহকে স্মরণ করে বলেন: হে অবস্থাসমূহের পরিবর্তনকারী আমাদের অবস্থাকে সর্বোত্তম অবস্থায় রূপান্তরিত করুন। এভাবে ইরানিরা নওরোজের সময় আল্লাহর স্মরণ বা আল্লাহর দিকে মনোযোগ জোরদার করেন। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়াও ইরানিরা নওরোজ উপলক্ষে প্রিয়জন ও আত্মীয়-স্বজনদের দেখতে যান এবং এ সময় তারা গ্লানি, বিদ্বেষ ও মান-অভিমান দূর করেন ভালোবাসার মাধ্যমে।’
মুসলিম চিন্তাবিদরা মনে করেন, নওরোজের সঙ্গে ইসলামি শিক্ষা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার পর এই উৎসব কুসংস্কারমুক্ত হয়েছে। ইরানের বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ড. শারিয়াতি এ সম্পর্কে বলেন, “ইসলাম নওরোজের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে, একে বিক্ষিপ্ততার হাত থেকে রক্ষা করে এই উৎসবকে ধ্বংস থেকে বাঁচিয়েছে। ইসলাম আসার পর সম্পূর্ণ জাতীয় ঘরানার এই উৎসবে যোগ হয়েছে ধর্মীয় আমেজ। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ইরানিরা শুরু থেকেই ইসলামকে সাদরে গ্রহণ করেছে এবং এই ঐশী ধর্মের উন্নতি, সমৃদ্ধি ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।”
অন্যদিকে, সাহিত্যিকদের দৃষ্টিতে বসন্ত ঋতু হচ্ছে ন্যায়-ইনসাফ ও ভারসাম্যের মওসুম। ইরানে বসন্ত নাতিশীতোষ্ণ। শীতের প্রকোপ যেমন থাকে না, তেমনি থাকে না গ্রীষ্মের দাবদাহ। মহাকবি ফেরদৌসী নওরোজের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-
বসন্তের মেঘমালা থেকে নেমে আসে বৃষ্টির ফোঁটা
মাটির বুক থেকে ধুয়ে ফেলে যতসব দুশ্চিন্তা
পৃথিবী পূর্ণ হয় সবুজের সমারোহে এবং পানিতে নদী
দুঃখীর জীবনে এখন থাকে না কোন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
ধরাতল সজ্জিত হয় যেন এক বেহেশত রূপে
ইনসাফ ও দানের মহিমায় পৃথিবী পূর্ণ হয়
আর কল্যাণ ও নিরাপত্তায়, আর
দুষ্ট ও দুরাচারের হাত হয় অবরুদ্ধ।‘
বন্ধুরা, কবিতাটি শুনলে। এবারে রয়েছে বসন্ত ও নওরোজ নিয়ে ইরানি শিশুদের কণ্ঠে একটি ফার্সি গান।
বন্ধুরা, চমৎকার একটি গান শুনলে। তোমাদের নিশ্চয়ই গানটি বাংলা অনুষ্ঠান জানতে ইচ্ছে করছে! তোমাদের জন্য গানটির অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ আমির হোসেন। এ গানে বলা হয়েছে-
বসন্ত এলোরে! বসন্ত এলোরে!
ডালিম ফুলের মৌসুম এলোরে !
অর্ধেক আকাশ মেঘলা যখন
মন তার চায় বৃষ্টি হয়ে ঝরবে সবুজ চত্বরে!
কচি-কাঁচা তোরা ছুটে আয়রে
ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা, আয়রে ছুটে আয়রে!
দেখো তোমরা প্রাণ ভরে
চারদিকে ফুটেছে ফুল কত রংয়ের সমাহারে!
যেদিকে তাকাও সেদিকেই ফুল
শোনো কি সুন্দর গান গাইছে বুলবুল
উইলো গাছের শাখায় কি সমীরণ
দুলিয়ে প্রাণোচ্ছল আশার বকুল।
ঝর্ণা বয়ে যায় পাথরের বুক চিরে
সূর্যের কি সুন্দর আলোক ঝরে!
বসন্ত এলোরে! বসন্ত এলোরে!
ডালিম ফুলের মৌসুম এলোরে !
মাঠ বনানী আর মরু প্রান্তরে
কতো নক্সা আর ছবির মেলারে!
অর্ধেক আকাশ মেঘলা যখন
মন তার চায় বৃষ্টি হয়ে ঝরবে সবুজ চত্বরে!

বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে তোমাদের জন্য রয়েছে 'এক ব্যবসায়ী ও তার গাধার গল্প'।
বসন্তকালের এক সুন্দর সকাল। এক ব্যবসায়ী তার গাধার পিঠে কয়েক বস্তা লবণ নিয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। বাজারে নিয়ে সে এগুলো বিক্রি করবে। ব্যবসায়ী এবং গাধা এক সাথে হাঁটছে। কিছু দূর গিয়ে পথে একটি নদী পড়ে। দুর্ভাগ্যবশত গাধাটি পা পিছলে নদীতে পড়ে গেল। তখন গাধা বুঝতে পারল যে, তার পিঠের বোঝা হালকা লাগছে। মূলত বস্তায় পানি লেগে লবন গলে যাওয়ার কারণে বোঝা হালকা হয়ে গেছে।
ব্যবসায়ী আর কোনো উপায় না দেখে বাড়ি ফিরে এলো এবং গাধার পিঠে আরো কয়েক বস্তা লবন নিয়ে আবার বাজারের পথে রওয়ানা হলো। তারা যখন নদীর পিচ্ছিল তীরে পৌঁছে তখন গাধাটি ইচ্ছে করে নদীতে পড়ে গেল। ফলে লবণগুলো আবার নষ্ট হয়ে গেল।
ব্যবসায়ী কিন্তু গাধার কৌশল বুঝে ফেলেছে। তাই এবার বাড়ি ফিরে সে স্পঞ্জ ভর্তি বস্তা দিয়ে গাধার পিঠ বোঝাই করল। বোকা গাধা পথ চলতে চলতে নদীর কিনারে এসে পুনরায় নদীতে পড়ে গেল। কিন্তু হায়, তার পিঠের বোঝা হালকা না হয়ে এবার ভারী হয়ে উঠেছে। ব্যবসায়ী তখন গাধার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে, ‘হে বোকা গাধা! তোমার কৌশল আমি বুঝে নিয়েছি। কিন্তু তোমার জেনে রাখা উচিত, অতি চালাকের গলায় দড়ি।’

গল্পটি শুনলে। বন্ধুরা, এবার তোমাদের জন্য রয়েছে এক লোভী ইঁদুরের গল্প।
অনেক দিন আগের কথা। একটি ছোট গ্রামে বাস করত এক বৃদ্ধ চাষী। তার ছিল কিছু কৃষি জমি। এ জমিতে সে গমের চাষ করত এবং গম থেকে তৈরি রুটি খেয়ে জীবনধারণ করত। প্রতিবছর তার জমিতে প্রচুর গম হতো। কৃষক তার উৎপাদিত গম বড় বড় বস্তায় ভরে ঘরের এক কোনায় রেখে দিত।
একদিন দুটি ইঁদুর এই গম দেখতে পেল এবং সঙ্গে সঙ্গেই তারা একটা পরিকল্পনা আঁটলো। তারা ঘরের দেয়ালে একটি গর্ত করল। কৃষক বাইরে চলে গেলেই ইঁদুর দুটি গর্ত থেকে বেরিয়ে আসত এবং বস্তা ছিদ্র করে গম বের করে নিজেদের গর্তে নিয়ে যেত। এভাবে দিন যেতে থাকল এবং একসময় অনেক গম তাদের গর্তে জমা হলো।
একদিন এক ইঁদুর অপর ইঁদুরকে বলল: ‘শোন বন্ধু! আমরা অনেক গম জমা করেছি। কৃষক জানার আগেই আমাদের গম নেয়া বন্ধ করা উচিত। আর তা না হলে আমরা বিপদে পড়ে যেতে পারি।’
দ্বিতীয় ইঁদুরটি বলল: ‘তুমি এসব কি বলছ? আমরা কখনো এমন সুযোগ আর পাব না। কৃষক জানার আগেই চলো আমরা আরো গম মজুদ করি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
প্রথম ইঁদুরটি বলল: ‘আমি আর তোমার সঙ্গে আসতে চাই না। কারণ, আমি আমার জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চাই না।’
জবাবে দ্বিতীয় ইঁদুর বলল: ‘তুমি আস্ত একটা ভীতু। আগামীকাল থেকে আমি একাই এখানে আসব এবং গম নিয়ে গর্ত ভর্তি করব। তোমার মতো একজন ভীতু বন্ধুর আমার প্রয়োজন নেই।’
পরের দিন থেকে লোভী ইঁদুরটি তার নিজের জন্য আরো গম সংগ্রহ শুরু করল। একদিন কৃষক মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল যে, তার গমের বস্তাগুলো পরীক্ষা করে দেখবে। গমের বস্তার কাছে গিয়ে কৃষক দেখতে পেল সবগুলো বস্তাতেই শুধু ছিদ্র আর ছিদ্র। এতে তার খুব রাগ হলো। সে ইঁদুর ধরার জন্য একটি ফাঁদ বস্তার কাছে পেতে রাখল। লোভী ইঁদুরটি যখন গম নিতে বস্তার কাছে এল অমনি সেই ফাঁদে আটকা পড়ে গেল।
এ গল্প থেকে আমরা শিখতে পারলাম যে, পৃথিবীর ধন-সম্পদের প্রতি লোভীর দৃষ্টান্ত হচ্ছে গুটি পোকার ন্যায়। সে যতই তার চারিদিকে রেশম সুতা জড়াতে থাকে ততই সে নিজে বন্দি হয়ে পড়ে এবং এভাবেই তার মৃত্যু ঘটে।
বন্ধুরা, ফার্সি নববর্ষ বা নওরোজ উপলক্ষে আমাদের সব আয়োজন একে একে ফুরিয়ে গেল। তবে অনুষ্ঠান থেকে বিদায় নেওয়ার আগে তোমাদের জন্য রয়েছে একটি দেশের গান। গানের কথা লিখেছেন তাসনিম যায়েদ, সুর করেছেন শেখ মোঃ ওয়ালিউল্লাহ আর গেয়েছে বাংলাদেশের একঝাঁক শিশু শিল্পী।
এ গানটি ঋতুরাজ বসন্তের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তো, পুরোনো দিনের সব মলিনতা, জড়তা, গ্লানি ও হতাশা আমাদের জীবন থেকে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাক এবং নতুনত্বের প্রাণ-প্রবাহে গড়ে উঠুক উন্নত, সফল ও স্বার্থক মানবজীবন- এ প্রত্যাশা করে রংধনুর আজকের আসর থেকে বিদায় নিচ্ছি। কথা হবে আবারো আগামী সপ্তাহে।#
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২৭