মার্চ ২৯, ২০২২ ১৯:২৩ Asia/Dhaka

আজ আমরা ইরানের পক্ষ থেকে চালানো মেরসাদ অভিযানে মোনাফেকিন গোষ্ঠীর শোচনীয় পরাজয় সম্পর্কে আলোচনা করব।

ইরানের ওপর ইরাকের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ সেদিনই শেষ হয় যেদিন ইরাকি বাহিনী ইরানের আহওয়াজ ও কেরমানশাহ ফ্রন্ট দিয়ে অগ্রসর হতে গিয়ে প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হয়। ইরানি যোদ্ধারা ১৯৮৮ সালের ২৩ জুলাই আহওয়াজ-খোররামশাহ মহাসড়ক ধরে এগিয়ে আসা ইরাকি বাহিনীকে পরাজিত করে তাদের পিছু হটিয়ে দেন। এর দু’দিন পর ২৫ জুলাই কেরমানশাহ শহরের কাছে সন্ত্রাসী মোনাফেকিন গোষ্ঠী ইরানে আগ্রাসন চালাতে গিয়ে শোচনীয়ভাবে পর্যুদস্ত হয়। এর পরপরই ইরাকি শাসক সাদ্দাম জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হন।  সাদ্দামের লেলিয়ে দেওয়া দুই বাহিনী পরপর দুই সংঘর্ষে ইরানি যোদ্ধাদের হাতে পরাজিত হওয়ার ফলে যুদ্ধ পরিস্থিতি আবার ইরানের অনুকূলে চলে আসে। পরিস্থিতি এতটা পাল্টে যায় যে, ইরানি যোদ্ধারা ইরাকি সেনাদেরকে তাড়িয়ে ইরাকের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ার অবস্থায় চলে যায়।

এ সময় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শনের জন্য আহওয়াজ সফর করছিলেন। তিনি টেলিফোন করে ইমাম খোমেনী (রহ.)’র ছেলেকে একথা জানান যে, আমাদের যোদ্ধারা তাদের অভিযান অব্যাহত রাখতে এবং ইরাকের ভেতরে ঢুকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। তারা ইমামের অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে। ইমামের ছেলে আহমাদ খোমেনী বিষয়টি ইমাম খোমেনীকে জানালে তিনি জবাবে বলেন: কোনো অবস্থায় ইরাকে হামলা করবে না। এমনকি তাদের দিকে একটি গুলিও ছুঁড়বে না। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে আমরা যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছি। এখন এটি কোনো অবস্থায় লঙ্ঘন করা যাবে না।

১৯৮৮ সালের ১৮ জুলাই ইরান জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার পর থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ইরান ও ইরাকের প্রতিনিধিদের মধ্যে কয়েক দফা পরোক্ষ আলোচনা হয়। এরইমধ্যে ওই বছরের ১৯ আগস্ট জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ৬১৯ নম্বর প্রস্তাব পাস করে। এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে বিশ্বের ২৫টি দেশের প্রায় ৪০০ সামরিক পর্যবেক্ষককে ইরান ও ইরাকে মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত হয়। এবারের প্রস্তাবটি পাস হওয়ার পরপরই ইরাক-ইরান সীমান্তে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায় এবং কার্যত পরদিন অর্থাৎ ১৯৮৮ সালের ২০ আগস্ট দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।

যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অঙ্গনে দু’টি সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হতে থাকে।  হয় আট বছরের যুদ্ধ শেষে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে এবার শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে। অথবা ইরাক ও ইরান এবার এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার জন্য স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত হবে। দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস এক বিশ্লেষণে সাদ্দাম বাহিনীর ইরান আগ্রাসনের কথা উল্লেখ করে জানায়, ইরাকি শাসক সাদ্দাম ইরানের সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে দেশটিতে আগ্রাসন চালিয়েছিল। তবে এই আগ্রাসন সাদ্দামের জন্য সমসাময়িক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পরাজয় বয়ে আনে। কারণ, সাদ্দাম কয়েকদিনের মধ্যে ইরানের রাজধানী তেহরানে বসে চা খাওয়ার বাসনা নিয়ে ১৯৮০ সালে এই আগ্রাসন চালালেও আট বছর পরও তার সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। অন্যদিকে এই আগ্রাসনের ফলে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর ইসলামি শাসনব্যবস্থার পেছনে গোটা ইরানি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

মার্কিন দৈনিকটির ভাষায়, ইরানের ওপর আট বছর ধরে আগ্রাসন চালিয়ে ইরাকি শাসক সাদ্দাম তেমন কিছুই অর্জন করতে পারেননি। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই বৃহৎ শক্তির সমর্থন নিয়ে নিজের সিংহাসনটি ধরে রাখতে পেরেছেন মাত্র। আর এখান থেকে বৃহৎ শক্তিগুলোর ওপর ইরাক সরকারের নির্ভরশীলতার বিষয়টিই কেবল ফুটে উঠেছে। বড় শক্তিগুলোর এত পৃষ্ঠপোষকতা সত্ত্বেও ইরাকি শাসক সাদ্দাম আট বছরের যুদ্ধে ইরানের বিরুদ্ধে নিশ্চিত বিজয় লাভ করতে পারেননি। কিন্তু ইরান শুধুমাত্র জনগণের শক্তির ওপর নির্ভর করে ইসলামি ও বিপ্লবী স্বকীয়তা বজায় রেখে নিজের রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থাকে অটুট রাখতে সক্ষম হয়।

ইরাক-ইরান যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এ অঞ্চলের অন্যান্য সমস্যা বিশেষ করে আরব-ইসরাইল সংকটের দিকে মনযোগী হয়। এ সম্পর্কে বিবিসি লন্ডন এক বিশ্লেষণে আরব-ইসরাইল সংকটের দিকে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি নিবদ্ধ করার কারণ হিসেবে ইরান-ইরাক যুদ্ধ শেষ হওয়ার কথা উল্লেখ করে। স্বাভাবিকভাবে এতে খুশি হতে পারেনি ইহুদিবাদীরা। ইহুদিবাদী ইসরাইল ও তার পশ্চিমা সহযোগীরা আরব-ইসরাইল দ্বন্দ্বের দিকে গোটা বিশ্বের মনোনিবেশে উদ্বেগ প্রকাশ করে। এদিকে ইরান ও ইরাকের মধ্যে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার পর জাতিসংঘ এই দুই দেশকে পরস্পরের দাবি-দাওয়া শোনার জন্য মুখোমুখি বৈঠকে বসার আহ্বান জানায়। জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৮৮ সালের শরতে জেনেভায় জাতিসংঘেরই মধ্যস্থতায় ইরান ও ইরাকের প্রতিনিধিরা আলোচনায় মিলিত হন।

জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে ইরান ও ইরাকের প্রতিনিধিরা আলাদা আলাদা দরজা দিয়ে সভাকক্ষে প্রবেশ করেন। দুই দেশের প্রতিনিধিরা জাতিসংঘের মধ্যস্থতাকারীর দিকে তাকিয়ে নিজ নিজ বক্তব্য রাখেন। তবে এই আলোচনার মাধ্যমে ইরান ও ইরাকের মধ্যে সরাসরি আলোচনা না করার যে বদনাম ছিল তা দূর হয় এবং দুই দেশ ধীরে ধীরে নিজেরাই মুখোমুখী আলোচনায় বসতে শুরু করে। এদিকে ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার জন্য ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আটটি কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৯০ সালের গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত জেনেভা ও নিউ ইয়র্কে দুই দেশের মধ্যে ম্যারাথন আলোচনা চলতে থাকে। ইরাকি শাসক সাদ্দাম যুদ্ধের ময়দানে যেসব লক্ষ্য অর্জন করতে পারেননি এই আলোচনার মাধ্যমে সেসব লক্ষ্য অর্জন করার চেষ্টা চালান।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /২৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ