এপ্রিল ০৫, ২০২২ ১৯:৪১ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ইরাকি শাসক সাদ্দামের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার পর ইরান ও ইরাকের মধ্যে শুরু হওয়া দীর্ঘমেয়াদি আলোচনা সম্পর্ক কথা বলেছি। আজ আমরা দুই দেশের প্রেসিডেন্টের মধ্যে শান্তি আলোচনা সংক্রান্ত চিঠি বিনিময় ও এসব চিঠির বিষয়বস্তু তুলে ধরার চেষ্টা করব।

ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম কুয়েত দখল করে নেওয়ার পর তার বাহিনীকে কুয়েত থেকে হটাতে আমেরিকার নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সামরিক জোট গঠিত হয়। এ অবস্থায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ইরান সীমান্তকে নিরাপদ করা প্রয়োজন মনে করে বাগদাদ।  সাদ্দাম ইরানের বিরুদ্ধে আট বছরের যুদ্ধের সময় যেমন আরব দেশগুলোর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছিলেন তেমনি কুয়েত দখলের সময় নিজেকে সাম্রাজ্যবাদ ও ইহুদিবাদ বিরোধী হিসেবে তুলে ধরে মুসলিম দেশগুলোর সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করেন।  এ লক্ষ্যে ইরাকি শাসক সাদ্দাম ইরানের সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর না হওয়া সত্ত্বেও কুয়েত আগ্রাসনে তেহরানের সমর্থন কামনা করেন। কিন্তু ইরান সরকার সাদ্দামের সে দাবি মেনে নেয়নি। ফলে সাদ্দাম ইরানের সবগুলো দাবি মেনে নিয় তেহরানের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।                      

ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাশেমি রাফজানজানিকে লেখা প্রথম চিঠিতে সাদ্দাম বলেন, ইরাক একসঙ্গে ইহুদিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের শিকার। কারণ, ইহুদিবাদীদের সম্প্রসারণকামী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে ইরাক। শত্রুরা ইরাককে দুর্বল করে ইহুদিবাদী ইসরাইলের হাতে ফিলিস্তিনিদের ওপর আরো বেশি গণহত্যা চালানোর সুযোগ করে দিতে চায়। এই অপশক্তি আবার ইরান ও ইরাকের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে চায় যেখানে আরব দেশগুলো বাগদাদের পক্ষ অবলম্বন করবে। সাদ্দামের ওই চিঠির জবাবে ইরানের প্রেসিডেন্ট আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফজানজানি এক চিঠিতে জানান: “আরব দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের কোনো সংঘাত নেই; এমনকি কোনো কোনো আরব দেশের সঙ্গে আমাদের সখ্য রয়েছে। এছাড়া, সারা বিশ্ব একথা জানে যে, ফিলিস্তিনি জাতির আসল হিতাকাঙ্ক্ষী ইরাক নয় বরং ইরান।

ইরাকি শাসক সাদ্দাম তার কথিত সাম্রাজ্যবাদ ও ইহুদিবাদ বিরোধী সংগ্রামে ইরানকে অংশগ্রহণ করার যে আহ্বান জানান তার জবাবে প্রেসিডেন্ট রাফসানজানি ১৯৯০ সালের ১৮ জুন এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আপনি নিজেকে ফিলিস্তিনিদের সুহৃদ এবং বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কাণ্ডারি বলে দাবি করছেন। আপনি আমাদেরকেও আপনার সঙ্গে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। কিন্তু এই চিঠির লেখকরা ভালো করে জানেন যে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরান সব সময় অগ্রগামী ছিল এবং এ কারণে তাকে দাম্ভিক শক্তিগুলোর রোষানলে পড়তে হয়েছে। যদি সবগুলো আরব দেশ ইরান বিপ্লবের প্রতি সমর্থন জানায় তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে শক্তির ভারসাম্য মুসলমানদের পক্ষে চলে আসবে।

সাদ্দাম তার প্রথম দুই চিঠিতে ইরানের সঙ্গে প্রতারণা করার চেষ্টা করেন এবং প্রমাণ করেন তিনি শান্তি চান না। এ কারণে ইরানের প্রেসিডেন্ট ১৬ জুলাই লেখা সাদ্দামের তৃতীয় চিঠির জবাব দেননি। ওই চিঠিতে সাদ্দামের পক্ষ থেকে তেহরানে একজন বিশেষ দূত পাঠানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এরপর ইরাকি শাসক তার চতুর্থ চিঠিতে ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হওয়ার প্রস্তাব দ্বিতীয়বারের মতো উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, দু’দেশের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি সই হওয়া প্রয়োজন এবং ওই চুক্তি স্বাক্ষরের দুই মাসের মধ্যে দু’দেশের সেনাদেরকে যার যার সীমান্তে ফিরিয়ে নিতে এবং যুদ্ধবন্দি বিনিময় সম্পন্ন করতে হবে।

কিন্তু এই চিঠিতে সাদ্দাম আবার আরভান্দ নদীকে ইরাকের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ঘোষণা করেন। অথচ ১৯৮০ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরুর অন্যতম কারণ ছিল বাগদাদের পক্ষ থেকে এই নদীর মালিকানা দাবি। সাদ্দামের পক্ষ থেকে এই অন্যায় দাবি উত্থাপনের কারণে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইরাকি শাসকের চতুর্থ চিঠিরও জবাব দেয়ার প্রয়োজন মনে করেননি।

১৯৯০ সালের ৩ আগস্ট কুয়েত দখল করার একদিন পর ইরাকি শাসক ইরানের প্রেসিডেন্টকে পঞ্চম চিঠিটি পাঠান। ওই চিঠিতে ইরান ইরাকের শত্রুদের সঙ্গে হাত মেলায় কিনা সে উদ্বেগের কথা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন তিনি। সাদ্দাম দাবি করেন, ইরাকের কুয়েত দখল আরবদের বিষয় এবং এখানে ‘অনারব’ ইরানের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাশেমি রাফসানজানি ১৯৯০ সালের ৭ আগস্ট সাদ্দামের পঞ্চম চিঠির পাশাপাশি চতুর্থ চিঠিরও আংশিক জবাব দেন।

ইরানের প্রেসিডেন্ট আরভান্দ নদী সংক্রান্ত সাদ্দামের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, আমরা ১৯৭৫ সালের আলজিয়ার্স চুক্তি অনুযায়ী শান্তি আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। কারণ, অতীতের চুক্তিগুলোকে উপেক্ষা করে বিশেষ করে যে আলজিয়ার্স চুক্তিতে আপনার নিজের স্বাক্ষর রয়েছে সে চুক্তি বাস্তবায়িত না হলে আজ আপনি যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তাও সফলভাবে বাস্তবায়িত হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। এছাড়া, আপনি ইরানের দখলীকৃত ভূমি থেকে সেনা সরিয়ে নিতে দুই মাসের যে সময়ের কথা বলেছেন তাও অগ্রহণযোগ্য। কারণ, সদিচ্ছা থাকলে মাত্র এক থেকে দু’দিনের মধ্যে এ কাজ করা সম্ভব। অবশ্য জাতিসংঘ মহাসচিব ইরাকি সেনা সরিয়ে নেওয়ার জন্য দুই সপ্তাহের সময়সীমা ঘোষণা করেছিলেন।

প্রেসিডেন্ট রাফসানজানি তার চিঠিতে ইরাকের কুয়েত দখলেরও বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, যখন ইরাক ও ইরানের মধ্যে শান্তি আলোচনা চলছে তখন কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা বা সমন্বয় ছাড়াই একটি প্রতিবেশী দেশ দখলকে মেনে নেওয়া যায় না। এছাড়া, বিগত কয়েক মাসের আলোচনায় ইরাকের পক্ষ থেকে সদিচ্ছার প্রমাণস্বরূপ কোনো পদক্ষেপ নিতেও দেখা যায়নি।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /০৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ