এপ্রিল ০৬, ২০২২ ১৭:২৪ Asia/Dhaka

ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন ইরানের প্রেসিডেন্টকে লেখা পাঁচটি চিঠিতে পরস্পরবিরোধী অনেক বক্তব্য দেন। ইরানের ওপর আট বছরের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের শেষে তিনি এমন একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করতে চেয়েছিলেন যাতে তার আগ্রাসী মনোবাসনাগুলো পূর্ণ হয়।

এসব চিঠির জবাবে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাশেমি রাফসানজানি সাফ জানিয়ে দেন, ইরানের ভূমি থেকে সব ইরাকি সেনাকে আন্তর্জাতিক সীমান্তের ওপারে প্রত্যাহার করলেই কেবল যুদ্ধবিরতি চুক্তি হতে পারে এবং তাও হতে হবে ১৯৭৫ সালের আলজিয়ার্স চুক্তি অনুযায়ী। সাদ্দাম ইরানের সঙ্গে এই চিঠি আদানপ্রদানের মধ্যেই কুয়েত দখল করেন এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ইরাকি বাহিনীকে কুয়েত থেকে হটিয়ে দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক জোট গঠিত হয়।

এ কারণে সাদ্দাম কুয়েতের দিকে পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করার জন্য ইরানের সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শান্তিচুক্তি সই করতে চেয়েছিলেন। কাজেই তার পক্ষে ইরানের দাবি মেনে নিয়ে আলজিয়ার্স চুক্তির ভিত্তিতে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করা ছাড়া উপায় ছিল না। এটি হচ্ছে সেই আলজিয়ার্স চুক্তি যা সাদ্দাম ১৯৮০ সালে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে ছিঁড়ে ফেলে ইরানের ওপর ভয়াবহ আগ্রাসন শুরু করেছিলেন। প্রায় তিন মাসের চিঠি আদানপ্রদান শেষে ইরাকি শাসক শেষ পর্যন্ত ইরানের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন এবং ১৯৯০ সালের ১৪ আগস্ট নিজের ষষ্ঠ ও শেষ চিঠিতে ইরানের প্রেসিডেন্টকে বিষয়টি জানিয়ে দেন।

ওই চিঠির প্রথম ধারায় ১৯৭৫ সালে স্বাক্ষরিত আলজিয়ার্স চুক্তি মেনে নেয়ার কথা বলা হয় এবং এটির তৃতীয় ধারায় লেখা হয়: “আমরা ১৯৯০ সালের ১৭ আগস্ট ইরানি ভূমি থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করতে যাচ্ছি।” আর চিঠির চার নম্বর ধারায় বলা হয়: “আমরা ওই একই দিন বন্দি মুক্তি দেয়ার কাজটিও শুরু করব।”

ফলে ১৯৯০ সালের ১৪ আগস্ট ইরানের ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিনে পরিণত হয়। ওই দিন আট বছরের প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানের বিজয় সুনিশ্চিত হয় এবং বিজয়ের সে স্বীকৃতিও আসে ইরাকি শাসক সাদ্দামের কাছ থেকে।

ওই দিন বাগদাদের স্বৈরশাসক ইরানকে ষষ্ঠ চিঠিটি লেখেন এবং সেখানে তিনি বলেন: “ইরানের প্রেসিডেন্ট সম্মানিত জনাব হাশেমি রাফসানজানি! আমাদের এ সিদ্ধান্তের ফলে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেল এবং আপনারা এতদিন ধরে যা কিছু চেয়েছিলেন তার সবকিছু পেয়ে গেলেন। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাশেমি রাফসানজানি ১৯৯০ সালের ১৮ আগস্ট সাদ্দামকে চতুর্থ ও শেষ চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে বলা হয়: আপনারা ইরানের ভূমি থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করে নিজেদের সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়েছেন। এখন আমরা তেহরানে আপনাদের কূটনীতিক গ্রহণ করতে প্রস্তুত রয়েছি। আশা করছি পারস্পরিক ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দু’টি মুসলিম উম্মাহর মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।

এভাবে দু’দেশের মধ্যকার সমঝোতা অনুযায়ী ইরাক ১৯৯০ সালের ২১ আগস্টের মধ্যে ইরানের ভূমি থেকে নিজের সব সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর শুরু হয় দু’দেশের কাছে থাকা যুদ্ধবন্দি বিনিময়। ইরান থেকে ইরাকের সেনা প্রত্যাহরের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে ফলাও করে প্রচারিত হয়। সে সময় ইরাকের দখলদারিত্ব থেকে কুয়েত মুক্ত করার লক্ষ্যে সামরিক প্রস্তুতি নিচ্ছিল আমেরিকা। ইরাকি সেনা প্রত্যাহারের খবর সম্পর্কে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ বলেন: ইরাকের পক্ষ থেকে ইরানের সব দাবি মেনে নেয়া ছিল তার জন্য বিস্ময়ের ব্যাপার।

এদিকে কুয়েত ও সৌদি আরবসহ যেসব আরব দেশ বিগত আট বছরের যুদ্ধে ইরাককে সব রকম পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এসেছিল সেসব দেশের প্রতিক্রিয়াও ছিল উল্লেখযোগ্য। সৌদি আরবের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স নায়েফ বিন আব্দুলআজিজ বলেন, আমার মতে, সাম্প্রতিক শান্তি চুক্তিতে ইরান যা কিছু চেয়েছিল তার সবই পেয়ে গেছে। সার্বিকভাবে ইরাক ১৯৭৫ সালের আলজিয়ার্স চুক্তি মেনে নেওয়ার ফলে সাদ্দাম সরকারের পাশাপাশি আট বছরের যুদ্ধে যারাই ইরাককে সহযোগিতা করেছে তাদের সবার জন্য ঘটনাটি ছিল একটি শক্ত চপেটাঘাত।

আলজিয়ার্স চুক্তি মেনে নেওয়ার পর সাদ্দাম সরকার ইরানের প্রেসিডেন্টকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো একে একে বাস্তবায়ন করতে থাকে।  ১৯৯০ সালের ১৭ আগস্ট ইরাকের হাতে বন্দি এক হাজার ইরানি যোদ্ধার প্রথম দলটি মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে আসেন। পরদিন একই সংখ্যক ইরানি যুদ্ধবন্দি মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ইরানও আস্তে আস্তে ইরাকি যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দিতে থাকে। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ ইরাক ও ইরানের ৪০ হাজার করে অর্থাৎ মোট ৮০ হাজার সৈন্য মুক্তি পেয়ে নিজে নিজ দেশে ফিরে যায়।

ইরাকের কুয়েত দখলের আগ পর্যন্ত জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে জেনেভায় ইরান ও ইরাকের প্রতিনিধিরা পরোক্ষ ও গোপন আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ১৯৯০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারেক আজিজের তেহরান সফর এবং একই বছরের ১৪ নভেম্বর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ইরাক সফরের পর দু’দেশ প্রকাশ্য আলোচনা শুরু করে। ১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসে ইরান ও ইরাকে পরস্পরের দূতাবাসের কার্যক্রম আবার শুরু হয় এবং চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স পর্যায়ে সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়।

সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৯৯১ সালের ৮ জানুয়ারি ইরাকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ্জাত ইব্রাহিম তেহরান সফরে আসেন। ইরাক কুয়েত দখল করার পর বাগদাদের সাবেক মিত্ররা ১৯৮০’র দশকে সাদ্দামের ইরান আগ্রাসনকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ কারণেই সাদ্দাম সরকার ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /০৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ