এপ্রিল ১২, ২০২২ ১৮:১০ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ইরাকের পক্ষ থেকে আলজিয়ার্স চুক্তি মেনে নেয়া সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজ আমরা জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ইরাককে আগ্রাসী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করার গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে কথা বলব।

১৯৭৫ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে ইরানের তৎকালীন শাহ ও ইরাকি শাসক সাদ্দামের মধ্যে বিখ্যাত আলজিয়ার্স চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তিতে আরভান্দ নদীর ভাগ্য নির্ধারণসহ দু’দেশের সীমান্ত নিয়ে সব মতবিরোধের অবসান ঘটে। কিন্তু ইরানে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব হওয়ার পর ১৯৮০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সাদ্দাম টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে আলজিয়ার্স চুক্তি ছিঁড়ে ফেলেন এবং আরভান্দ নদীর ওপর ইরাকের পূর্ণ কর্তৃত্ব দাবি করেন। ওই দাবি আদায় করার অজুহাতে ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরাকি বাহিনী ইরানের ওপর সর্বাত্মক আগ্রাসন চালায় যার কারণে দু’দেশের মধ্যে আট বছরব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয়।

আলজিয়ার্স চুক্তি বাতিল ছাড়াও ইরানের ওপর ইরাকের আগ্রাসনের আরো দু’টি উদ্দেশ্য ছিল- ইরানের খুজিস্তান প্রদেশকে ইরাকের অন্তর্ভুক্ত করা এবং ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থার পতন ঘটানো।  কিন্তু ইরাকি স্বৈরশাসক সাদ্দাম তার এই আগ্রাসী পরিকল্পনার একটিও বাস্তবায়ন করতে পারেননি। ১৯৮৮ সালে আট বছরের যুদ্ধ শেষ হওয়ার দুই বছর পর ১৯৯০ সালে তিনি আলজিয়ার্স চুক্তির পাশাপাশি ইরানের সবগুলো দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। ওই ঘটনার পর তেহরানে নিযুক্ত তৎকালীন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত অ্যান্টনি পারসন্স এক বিশ্লেষণে বলেন, “সাদ্দাম ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হন এবং যখন তিনি বুঝতে পারেন ইরানকে কাবু করতে পারবেন না তখন নিজের অবস্থান থেকে পিছু হটে যান।”

ইরাক আলজিয়ার্স চুক্তি মেনে নেওয়ার পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাবের অন্যান্য ধারা বাস্তবায়নের প্রয়োজন দেখা দেয়। দু’দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময় ছাড়াও আট বছরের যুদ্ধের আগ্রাসী শক্তিকে চিহ্নিত করে তার কাছ থেকে আগ্রাসনের শিকার দেশের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় করার স্বার্থে এ প্রয়োজন দেখা দেয়।

এ প্রয়োজনকে সামনে রেখে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব জ্যাভিয়ার পেরেজ ডিকুয়েয়ার ১৯৯১ সালের ১৪ এপ্রিল ইরান ও ইরাকের কাছে চিঠি পাঠান। ওই চিঠিতে তিনি কোন দেশ আগ্রাসন শুরু করেছিল সে সম্পর্কে নিজ নিজ যুক্তি ও দলিল পেশ করার জন্য তেহরান ও বাগদাদের প্রতি আহ্বান জানান। জাতিসংঘের ওই আহ্বানকে উপহাস করে ইরাক সরকার। দেশটি ১৯৯১ সালের ২৬ আগস্ট কিছু দলিলসহ যেনতেনভাবে লেখা একটি চিঠি জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে পাঠায়।

কিন্তু ইরান ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সম্পূর্ণ তথ্য ও দলিলনির্ভর একটি জবাব জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে হস্তান্তর করে। ইরানের জবাবটি এত বড় ছিল যে, তা একটি বইয়ের আকার ধারণ করে।  জাতিসংঘ মহাসচিব নিজের উপদেষ্টাদের নিয়ে দুই দেশের বক্তব্য বিশ্লেষণ করার পর ১৯৯১ সালের ৯ ডিসেম্বর ৯ ধারাবিশিষ্ট একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদনে ইরাককে আগ্রাসী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরাক প্রথমে ইরানের ওপর হামলা চালায় যা ছিল জাতিসংঘ ঘোষণার সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন ছিল ইরাকের বিরুদ্ধে ইরানের আরেকটি বড় বিজয়।

জাতিসংঘ ইরানের ওপর আগ্রাসন চালানোর জন্য ইরাককে দায়ী করার পর ইরাকি শাসক সাদ্দাম ক্ষিপ্রগতিতে ইরানের প্রেসিডেন্ট রাফসানজানির কাছে চিঠি পাঠান। ওই চিঠি পাঠানো উদ্দেশ্য ছিল, সাময়িকভাবে ইরানের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলা যাতে ইরাকের পক্ষে কুয়েতে আগ্রাসন চালানোর পথে কোনো বাধা না থাকে। এছাড়া, ইরান যাতে ইরাকের এই উদ্যোগকে বাগদাদের সদিচ্ছা হিসেবে গ্রহণ করে নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাবের অন্যান্য ধারা বাস্তবায়ন করতে না চায় সে ব্যবস্থা করাও ছিল সাদ্দামের অন্যতম উদ্দেশ্য। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এমন সময় ইরাককে আগ্রাসী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে যখন যুদ্ধ চলার সময় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তি একবারের জন্যও ইরাককে আগ্রাসন বন্ধ করার আহ্বান জানায়নি। এসব শক্তি বরং উল্টো সাদ্দাম সরকারকে সব রকম পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তি শুধুমাত্র ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে ইরাককে ৮৪ বিলিয়ন ডলারের অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দিয়েছিল। সেনা সংখ্যার দিক দিয়ে সে সময় ইরাক ছিল বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম দেশ। ইরাকের সেনাসংখ্যা ছিল ১৮ লাখেরও বেশি। পাশাপাশি ইরাকের কাছে ছিল ৬০০ যুদ্ধবিমান ও ছয় হাজার ট্যাংক। আট বছর ইরানে আগ্রাসন চালিয়ে ইরাকি বাহিনী প্রভূত অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করেছিল। কাজেই যুদ্ধ শেষে ইরাকের এই বিশাল সামরিক শক্তি মধ্যপ্রাচ্যের অন্য যেকোনো দেশের জন্য এমনকি বড় শক্তিগুলোর জন্য সমস্যার কারণ হতে পারত। কাজেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য এবার ইরাকের এই সামরিক শক্তিকে ধ্বংস করার পরিকল্পনায় মেতে উঠল। এই প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে ইরাকের কুয়েত দখলকে নিছক সাদ্দামের আগ্রাসী মনোভাব বলে মনে হবে না। এমন অনেক দলিল রয়েছে যা দিয়ে প্রমাণ করা যাবে যে, সাদ্দাম আমেরিকার সবুজ সংকেত নিয়ে কুয়েত দখল করেছিলেন।

আর সেই ইরাকি বাহিনীকে কুয়েত থেকে বিতাড়িত করার অজুহাতে আমেরিকা ও তার মিত্ররা পারস্য উপসাগরে ব্যাপকভাবে সেনা সমাবেশ ঘটাতে পেরেছিল। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ইরাককে ইরানের ওপর আগ্রাসী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করার ফলে আমেরিকার কাছে সাদ্দামের প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল। তারপরও ইরাক যে কারণেই কুয়েত দখল করুক না কেন এই ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছিল সাদ্দাম একজন আগ্রাসী শাসক এবং আজ ইরান ও কাল কুয়েতে আগ্রাসন চালানোই তার একমাত্র কাজ। ইরাক কুয়েত দখল করার পর বিগত আট বছরের ইরাক-ইরান যুদ্ধে সাদ্দাম ও তার মিত্রদের অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়ে। আগামী আসরে আমরা এসব দেশের নেতৃবৃন্দের এসব স্বীকারোক্তি নিয়ে আলোচনা করব।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /১২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ