এপ্রিল ২১, ২০২২ ২১:১৯ Asia/Dhaka

গত আসরে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ইরাককে আগ্রাসী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করার ঘটনা নিয়ে কথা বলেছি। আজ আমরা ইরাকের প্রতি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ব্যাপক সহযোগিতা সম্পর্কে পশ্চিমা গণমাধ্যমের স্বীকারোক্তি সম্পর্কে আলোচনা করব।

ইরাক জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫০৯ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেয়ার পর দু’দেশের মধ্যকার আট বছরের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।  ইরাকি শাসক সাদ্দাম ১৯৭৫ সালে আলজেরিয়ার রাজধানীতে ইরানের তৎকালীন শাহ সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত আলজিয়ার্স চুক্তিও মেনে নিতে বাধ্য হন। এর জের ধরে ইরানের ভূখণ্ড থেকে সব ইরাকি সেনা প্রত্যাহার করা হয় এবং দু’দেশ পরস্পরের যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দেয়। জাতিসংঘ মহাসচিব পেরেজ ডি কুয়েলার প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান শেষে ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরু করার জন্য ইরাক সরকারকে দায়ী করেন। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা ছিল আট বছরের যুদ্ধে ইরানের আরেকটি বড় বিজয়। ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাবের সাত নম্বর ধারায় বিগত আট বছরের যুদ্ধে কোন দেশের কত ক্ষতি হয়েছে তার বিবরণ ছিল। এবার ইরাকি শাসক সাদ্দামকে আগ্রাসী ঘোষণা করার ফলে তার পক্ষ থেকে ইরানকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রসঙ্গ সামনে আসে।

নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের সাত নম্বর ধারা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে ইরানের দফায় দফায় আলোচনা হয়। ওই আলোচনার অংশ হিসেবে জাতিসংঘের তৎকালীন উপ মহাসচিব আব্দুর রহিম ফারাহ ১৯৯১ সালের ৩১ মে তেহরান সফরে আসেন। ফারাহর নেতৃত্বে যে প্রতিনিধিদলটি ইরান সফরে আসে সেটি ইরানের যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাগুলোর সঠিক চিত্র রেকর্ড করার জন্য প্রায় ছয় মাস এদেশে অবস্থান করে। তারা ইরানের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের ছবি ও তথ্যচিত্র সংরক্ষণ করে। এরপর ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে প্রতিনিধিদলটি যুদ্ধে ইরানের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্বলিত একটি বিশাল প্রতিবেদন জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে হস্তান্তর করে। মহাসচিব পেরেজ ডি কুয়েলারের দায়িত্ব পালনের মেয়াদ তখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। বিদায়ী মহাসচিব যুদ্ধে ইরানের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্বলিত প্রতিবেদনটি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করেন।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের পাঁচটি প্রদেশ ছিল যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু এবং আরো ১১টি প্রদেশেও ইরাক আগ্রাসন চালিয়েছে। যুদ্ধে ইরানের ৫০টি শহর ও চার হাজার গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইরানের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই যুদ্ধের ক্ষতির শিকার হয়। ইরাকি বাহিনী ইরানের প্রায় পাঁচ লাখ খেজুর গাছ ইচ্ছা করে কেটে ফেলে এবং এদেশের বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে যুদ্ধে ইরানের সরাসরি ক্ষতি ৯৯ বিলিয়ন ডলার ও পরোক্ষ ক্ষতি ১৫০ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ আগ্রাসন চালিয়ে ইরাক ইরানের মোট ২৪৯ কোটি ডলারের ক্ষতি করে। তবে জাতিসংঘের এ হিসাবকে চ্যালেঞ্জ করে ইরান যুদ্ধে নিজের ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার বিলিয়ন ডলার বলে ঘোষণা করে।

এদিকে, জাতিসংঘ ওই যুদ্ধে ইরানের ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করলেও নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাবে এই ক্ষতিপূরণ আদায়ের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

ইরান-ইরাক যুদ্ধ শেষ হওয়ার দুই বছরের মাথায় ইরাকি বাহিনী কুয়েত দখল করার ফলে পশ্চিমা ও আরব সরকারগুলোর পাশাপাশি তাদের গণমাধ্যমগুলো এমন কিছু বাস্তবতা প্রকাশ করে দেয় যা হয়তো কুয়েত দখল না হলে কোনোদিনও প্রকাশ করত না। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো জানায়, ইরাকের প্রতি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়েছে এবং ইরাকি বাহিনী ইরানের অনেক বেশি ক্ষতি করতে পেরেছে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত দৈনিক অবজারভার ১৯৯০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এক প্রতিবেদনে জানায়: সৌদি আরব, ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি ইরাককে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ না করত তাহলে ইরাকের পক্ষে ইরানের এত বেশি ক্ষতি করা সম্ভব ছিল না। ইরাকি সেনাবাহিনীর আকার ১৯৮০ সালের তুলনায় ১৯৮৮ সালে চারগুণ বেড়েছিল এবং দেশটির সামরিক বাহিনীর এই বিশাল ব্যয়ের সিংহভাগ বহন করেছিল সৌদি আরব ও কুয়েত। আরো যেসব দেশ ইরাককে সার্বিক সহযোগিতা করেছিল সেসব দেশের মধ্যে রয়েছে ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, জাপান ও আমেরিকা।

পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো এ সময় ইরাকি বাহিনীর রাসায়নিক হামলার পেছনে আমেরিকার মদদের কথা তুলে ধরে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত হেরাল্ড ট্রিবিউন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির উপদেষ্টা আর্থার শ্লিনজারের বরাত দিয়ে ১৯৯০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এক নিবন্ধে জানায়: সাদ্দাম যখন ব্যাপকভাবে রাসায়নিক হামলা চালাচ্ছিল তখন মার্কিন সরকার বাগদাদকে ‘কৃষিখাতে’ ১০০ কোটি ডলারের ঋণ প্রদান করে। ইহুদিবাদী ইসরাইলের রেডিও ১৯৯০ সালের ২৩ জুলাই ইরাকের প্রতি কুয়েতের অর্থ সাহায্যের কথা তুলে ধরতে গিয়ে জানায়, কুয়েত সরকার ইরানের বিরুদ্ধে ইরাককে বিজয়ী করার জন্য বাগদাদের হাতে কোটি কোটি ডলার অর্থ তুলে দিয়েছিল।

এদিকে ইরাকের প্রতি সৌদি সাহায্য সম্পর্কে দেশটির তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও বিমান বাহিনীর প্রধান খালেদ বিন সুলতান বিন আজিজ বলেন, “ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় ইরাকি সৈন্যদের কোল্ড ড্রিংস পর্যন্ত সৌদি আরব সরবরাহ করেছে।” বার্তা সংস্থা এপি তৎকালীন সৌদি রাজা ফাহাদের বরাত দিয়ে ১৯৯০ সালের ১৪ আগস্ট জানায়, ফাহাদ বলেন, ইরাক সরকার যদি দাবি করে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সে প্রচুর আত্মাহুতি দিয়েছে তাহলে আমি বলব আমরাও অর্থ, অত্যাধুনিক অস্ত্র ও আন্তর্জাতিক সহায়তা এনে দিয়ে তাদের আত্মাহুতিতে অংশগ্রহণ করেছি।  বার্তা সংস্থা রয়টার্স ১৯৯১ সালের ১৫ জুলাই ইরাকের প্রতি সৌদি আরবের সহায়তার সঠিক পরিসংখ্যান তুলে ধরে জানায়, রিয়াদ সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার আওতায় বাগদাদের হাতে দুই হাজার ৭০০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ তুলে দিয়েছিল।

এভাবে ইরানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আট বছরের যুদ্ধের ব্যয়ভার মিটিয়েছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো। এর আগে ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ১৯৮৬ সালে বলেছিল, ফ্রান্স যদি ইরাককে তিন সপ্তাহের জন্য সহযোগিতা বন্ধ করে দেয় তাহলে ইরানের মোকাবিলায় ইরাক পরাজিত হবে।

সার্বিকভাবে বলা যায়, যদি বাগদাদের প্রতি এরকম বিদেশি সাহায্যের ঢলের মোকাবিলায় ইরানের একাকি লড়াই করার বিষয়টিকে বিবেচনায় নেওয়া হয় তাহলে ইরাকের বিরুদ্ধে আট বছরের যুদ্ধে ইরানের বিজয়কে আরো বেশি গৌরবোজ্জ্বল মনে হবে।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /২১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ