মে ০৭, ২০২২ ১৯:৪২ Asia/Dhaka

আশা করছি আপনারা প্রত্যেকে ভালো আছেন। গত আসরে আমরা ইরাকের প্রতি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ব্যাপক সহযোগিতা নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমের স্বীকারোক্তি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ইরাকি শাসক সাদ্দামের ইরান আগ্রাসনের কারণ ও তার প্রতি দুই পরাশক্তির পূর্ণ সমর্থন সত্ত্বেও ইরানের বিজয়ে ইমাম খোমেনী (রহ.)’র নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে কথা বলব।

যেকোনো যুদ্ধে বিজয়ের অন্যতম মাপকাঠি হচ্ছে আগ্রাসী শক্তি ঠিক কি উদ্দেশ্যে যুদ্ধ শুরু করেছিল তা চিহ্নিত করা। ইরাকের তৎকালীন শাসক সাদ্দাম এবং তার রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী ইরানের সঙ্গে দেশটির সীমান্ত বিরোধ ও আলজিয়ার্স চুক্তি থেকে সাদ্দামের বেরিয়ে যাওয়া ছিল ওই যুদ্ধের একমাত্র কারণ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংস করা ও এদেশের একাংশ দখল করে ইরাকের মানচিত্রের অন্তর্গত করা ছিল সাদ্দামের ইরান আগ্রাসনের প্রধান দু’টি উদ্দেশ্য।  ইরাকি শাসক সাদ্দাম ১৯৮০ সালে ইরানে হামলা চালানোর সময় এক বক্তব্যে বলেন, “আমরা ইরানের ধ্বংস বা খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাওয়ায় অখুশি হবো না। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই যতদিন ইরান শত্রুতা করবে ততদিন প্রতিটি ইরাকি নাগরিক অথবা প্রতিটি আরব নাগরিক ইরানকে ধ্বংস করতে চাইবে।”

তৎকালীন ইরাকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারিক আজিজ এ সম্পর্কে বলেন, “একটি অখণ্ড ইরানের চেয়ে কয়েকটি ছোট ছোট ইরান আমাদের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। আমরা ইরানের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে বিদ্রোহে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে দেশটিকে খণ্ডবিখণ্ড করার চেষ্টা করব।” পশ্চিমা বিশ্লেষক ও লেখক অ্যান্টনি কোর্ডসম্যান এ সম্পর্কে বলেন, “যে দেশটিতে বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা একটি সরকার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল সেটিতে ইরাক পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই হামলা চালিয়েছিল বলে মনে হয়।  বাগদাদ ধরে নিয়েছিল আগ্রাসন চালিয়ে তারা ইরানকে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারবে। কিন্তু ওই হামলার ফল হয়েছিল ঠিক তার উল্টো। ইরাকি শীর্ষ নেতারাই তাদের সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন, তাদের হামলার ফলে ইরাকি জনগণ যে ঐক্যবদ্ধভাবে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর পাশে দাঁড়াবে- তা তারা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেনি।”

ইরাকি গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন ইরান বিভাগের প্রধান ওয়াফিক আস-সামারাই এ সম্পর্কে বলেন, “১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দুপুর ‌১২টায় ইরানের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর জন্য ইরাকি বিমান বাহিনীর ১৯২টি যুদ্ধবিমান আকাশে ওড়ে। ঠিক এ সময় ইরাকের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সাদ্দাম হোসেন সামরিক পোশাক পরে বাগদাদের অপারেশন্স কক্ষে প্রবেশ করেন।  এ সময় তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী আদদান খয়রুল্লাহ তাকে বলেন, “স্যার, আমাদের পাইলটরা ২০ মিনিট আগে ফ্লাই করেছে।” সাদ্দাম উত্তর দেন, “আগামী আধা ঘণ্টার মধ্যে ইরানের কোমর ভেঙে যাবে।” সাদ্দামের ওই ধারণার বিপরীতে ইরানের কোমর তো ভাঙেই নি বরং ইরানি যোদ্ধাদের দেশরক্ষার অকুতোভয় মানসিকতার কারণে তেহরান ধীরে ধীরে আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ইরানি যোদ্ধারা ইরাক সরকারকে এমন শিক্ষা দেন যে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পর থেকে শুরু করে এর শেষ দিন পর্যন্ত এ যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য বাগদাদকে অনুনয় বিনয় করতে হয়েছে।

ইরাক সরকার এমন সময় ইরানের কাছে উচিত শিক্ষা পায় যখন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তি বাগদাদকে সব রকম পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল। বিশিষ্ট মার্কিন সাংবাদিক অ্যালান ফ্রয়েডম্যান হোয়াইট হাউজের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “আমাদের সৈন্যরা যুদ্ধের ময়দানে ইরাকি সেনাদের ট্যাকটিক্যাল সহযোগিতা দিয়েছে। এমনকি কখনও কখনও ইরান সীমান্তে ইরাকি সৈন্যদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়েও যুদ্ধ করেছে মার্কিন সেনারা। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত এই অবস্থা বিদ্যমান ছিল।” হোয়াইট হাউজের তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক হাওয়ার্ড টিচের এ সম্পর্কে বলেন, “আমেরিকা সাদ্দামের জন্য যতটা করেছে তা তার ঘনিষ্ঠ মিত্রদের কেউ করেনি। ” বিশিষ্ট মার্কিন রাজনৈতিক ভাষ্যকার কেনেথ আর. টিমারম্যান বলেন, “সাদ্দাম ১৯৮২ সালের জুন মাসে বেলজিয়ামের একটি কোম্পানির সঙ্গে ৮৩ কোটি ডলারের একটি চুক্তি করেন। ইরাকি যুদ্ধবিমানগুলোর জন্য ভূপৃষ্ঠের ৫০ মিটার গভীরে ৫০০টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করার লক্ষ্যে ব্যয়বহুল ওই চুক্তি সই হয়েছিল।”

পশ্চিমা দেশগুলো শুধু প্রচলিত অস্ত্র দিয়েই সহযোগিতা করেনি সেইসঙ্গে ইরাককে নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্রও সরবরাহ করেছিল। আট বছরের যুদ্ধে ইরাকি সেনারা শুধুমাত্র রাসায়নিক হামলা চালিয়ে অন্তত এক লাখ মানুষকে হতাহত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইরাক-ইরান যুদ্ধের আগ পর্যন্ত এত ব্যাপক মাত্রায় আর কোথাও রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়নি। ইরাকি বাহিনীর রাসায়নিক হামলায় কেবল ইরানি যোদ্ধারা মারা পড়েননি সেইসঙ্গে বহুবার দুদেশের সীমান্তবর্তী বেসামরিক নাগরিকরা এ হামলার শিকার হয়েছেন।  যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তিন দশকেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এখনও ইরানের ৫০ হাজার নাগরিককে রাসায়নিক গ্যাসে আক্রান্ত থাকার কারণে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়।

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান আট বছরের অসম যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত বিজয় লাভ করে। আজকের আসর শেষ করব ১৯৮০’র দশকে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব পেরেজ ডি কুয়েলারের একটি বক্তব্য দিয়ে। তিনি মহাসচিব হিসেবে বিদায় নেয়ার আগে সর্বশেষ ভাষণে ইরান-ইরাক যুদ্ধে ইরাককে আগ্রাসী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, বিগত আট বছরে ইরান যেটা করেছে সেটা ছিল আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা। দু’টি দেশের সেনাবাহিনী যখন পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তখন সে যুদ্ধ হয় একরকম। আর একটি দেশের আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে যখন আরেকটি দেশের আপামর  জনসাধারণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে তখন তার অর্থ দাঁড়ায় অন্যরকম। আর এই যুদ্ধে ইরান আগ্রাসী বাহিনীকে পরাজিত করেছে।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /০৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ