এপ্রিল ২৫, ২০২২ ১৬:০৯ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। প্রত্যেক আসরের মতো আজও তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশিদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য চেষ্টা ও শ্রমের কোনো বিকল্প নেই। যে ব্যক্তি পরিশ্রম ও কাজ করতে অনীহা করে, সে আসলে মানবতা এবং ধর্মীয় সংস্কৃতি সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। কারণ, ধর্ম মানুষকে তার বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে বলেছে। ধার্মিক ব্যক্তি কোনো অবস্থায়ই কাজ করতে ভয় পায় না, বরং কর্মকে নিজের সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক বলে মনে করে।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে শ্রমিকের হাতে চুমু খেতেন। তাবুকের যুদ্ধ শেষে রাসূলে খোদা যখন মদীনায় ফিরে আসেন তখন বিশিষ্ট সাহাবি সা'দ আনসারি তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। রাসূলুল্লাহ আনসারির সঙ্গে হাত মিলিয়ে তার হাতের তালুতে কঠোর পরিশ্রমের ফলে সৃষ্ট খসখসে দাগ অনুভব করেন। তিনি বুঝতে পারেন, অধিক পরিশ্রমের ফলে সা'দ আনসারির হাতের তালু ফেটে গেছে। তিনি আনসারির হাতে চুমু খেয়ে বললেন, "এই হাতে কখনো জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না।"

ইসলামর্ম সংসারের ভরণপোষণের জন্য হালাল উপায়ে উপার্জনকে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের সঙ্গে তুলনা করেছে এবং শ্রমিককে 'আল্লাহর পথের মুজাহিদ' বলে উল্লেখ করেছে। এ সম্পর্কে ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন : "যে ব্যক্তি পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য আল্লাহর কাছে রিযিক কামনা করে, তাকে জিহাদের চেয়েও বড় পুরস্কার দেয়া হয়।" এ ছাড়া, যে ব্যক্তি হালাল রুজি উপার্জনরত অবস্থায় মারা যায়, তার পুরস্কার শহীদের সমান।

বন্ধুরা, আজকের আসরের শুরুতেই থাকবে পরিশ্রমের সুফল সম্পর্কে একটি হাদিসের গল্প। এরপর শোনাব একটি নাতে রাসূল। আর সবশেষে থাকবে ক্রোধ থেকে বিরত থাকার প্রয়োজনীয় সম্পর্কে একটি সত্য ঘটনা। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে হাদিসের গল্পটি শোনা যাক।

বন্ধুরা, আমরা যার কথা বলছি তিনি একসময় অনেক কষ্ট-ক্লেশের মধ্য দিয়ে তার দিনগুলো কাটিয়েছেন। দিনগুলো তার এমন মন্দ কেটেছে যে, সারাদিন চেষ্টা করেও তিনি তার স্ত্রী ও নিষ্পাপ শিশুদের পেট ভরে খাবার যোগাড় করতে পারতেন না। মনে মনে তিনি একটি কথা চিন্তা-ভাবনা করতেন। যে কথাটি তার মনের মধ্যে জাগরণ এনে দিয়েছিল সে একটি মাত্র কথাই তার অন্তরে এক অসাধারণ শক্তি যুগিয়েছিল। সে কথাটিই তার জীবনে এনে দিয়েছিল এক বিপ্লব। বদলে দিয়েছিল তার দুর্দিনকে সুদিনে। কাল যে পরিবারটি সীমাহীন অভাব-অনটন আর সহায়-সম্বলহীন থাকার কারণে লজ্জা ও লাঞ্ছনার জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছিল, সে পরিবারটিই আজ একটি মাত্র কথার বরকতে সুখ স্বাছন্দের জীবন যাপন করতে লাগল।

বন্ধুরা, আমরা যার কথা বলছি, তিনি আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর একজন সাহাবী। অভাব-অনটন আর দারিদ্র্য তার উপর ছেয়েছিল। একদিন তিনি যখন দুঃখ-কষ্টে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন। তখন তার স্ত্রী তাকে পরামর্শ দিলেন, “আপনি আপনার এ দুঃখ-কষ্টের কথা আল্লাহর নবী (সা.)-এর কাছে গিয়ে বলুন।”

স্ত্রীর পরামর্শে রাজী হয়ে স্থির করলেন যে, তিনি রাসূলের খেদমতে হাজির হয়ে নিজের অভাব-অনটনের কথা বলবেন এবং তার কাছ থেকে টাকা-পয়সা সাহায্য চাইবেন। এরপর একদিন তিনি তার মনের সংকল্প নিয়ে মহানবী (সা.)-এর দরবারে হাজির হলেন। কিন্তু তিনি তার সাহায্য চাওয়ার আগেই রাসূলের মুখ থেকে একটি কথা শুনতে পেলেন।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, "যে ব্যক্তি আমার নিকট সাহায্য চাইবে আমি তাকে সাহায্য করব। কিন্তু যদি কোনো লোক আল্লাহর সৃষ্টি কোনো মানুষের কাছে হাত পাতা থেকে বিরত থাকে তাহলে আল্লাহ তার অভাব মোচন করে দেবেন।"

এ কথা শুনে তিনি রাসূলের কাছে আর কিছু চাইতে পারলেন না এবং বাড়িতে ফিরে এলেন। ঘরে এসে দেখলেন যে, আগের মতোই দারিদ্র্য ও অভাবের পরিবেশ ছেয়ে আছে। বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় দিন আবার সে সংকল্প নিয়েই রাসূলের খেদমতে উপস্থিত হলেন। এ দিনও তিনি রাসূলের মুখে একই কথা শুনতে পেলেন।

রাসূল (সা.) বললেন, "যে ব্যক্তি আমার নিকট সাহায্য চাইবে আমি তাকে সাহায্য করবো। কিন্তু যদি কোনো লোক আল্লাহর বান্দার সামনে হাত পাতা থেকে বেঁচে থাকে তাহলে সত্য সত্যই আল্লাহ তাকে অপরের মুখাপেক্ষী করে রাখবেন না।"

এবারও তিনি তার মনের কথা না বলে বাড়ি ফিরে এলেন। কিন্তু ঘরের মধ্যে অভাব-অভিযোগ ও দারিদ্র্য লেগেই আছে। সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট ও অসহায় অবস্থা তাকে আবারও রাসূলের কাছে যেতে বাধ্য করল। তাই সাহায্য চাওয়ার প্রবল ইচ্ছা নিয়েই তিনি আবার মহানবীর নিকট গেলেন। এবারও তিনি রাসূলের কাছ থেকে একই কথা শুনতে পেলেন। আল্লাহর নবী (সা.) পূর্বের মতোই সে কথাটি আবার তাকে শোনালেন।

এবার রাসূল (সা.)-এর মুখ থেকে আগের কথাটি শোনার পর সাহাবী তার অন্তরে পরম প্রশান্তিবোধ করলেন। তিনি উপলব্ধি করতে লাগলেন যেন এই একটি মাত্র কথাই তার জীবনের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট দূর করার চাবিকাঠি। এবারে তিনি যখন রাসূলের (সা.) দরবার থেকে উঠে যেতে লাগলেন তখন তার মনের মধ্যে অসীম প্রশান্তি অনুভব করছিলেন। তার অন্তরে অত্যন্ত শান্তিও স্বস্তি নিয়ে তিনি নিজের বাড়ির দিকে এগিয়ে চললেন। আর মনে মনে ভাবতে লাগলেন, "আগামীতে আর কোনদিন কারো সামনে হাত পাতবেন না। যদি কারো কাছে কিছু চাইতেই হয় তাহলে নিজের প্রভু আল্লাহর কাছে চাইবেন। আর তাঁরই উপর ভরসা রেখে নিজের বাহুবলে কাজ করবেন। তিনিই আমাকে সফলতা দান করবেন এবং আমাকে সকল প্রকারের হাত পাতা থেকে রক্ষা করবেন।"

সাহাবী মনে মনে ভাবতে লাগলেন, আমার দ্বারা কোনো কাজ করা কি সম্ভব? তার মনে হলো, আপাততঃ তিনি জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে এনে বাজারে বিক্রি করতে পারবেন।

এ কথা ভেবে-চিন্তে তিনি তার প্রতিবেশীর কাছ থেকে একটা কুঠার ধার নিলেন এবং জঙ্গলে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরিশ্রম করে তিনি অনেক লাকড়ি জমা করলেন আর তা এনে বাজারে বিক্রি করলেন।

এভাবে তিনি দেখতে পেলেন তার পরিশ্রমের ফল খুবই ভালো। তাই তিনি তার এ কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। ধীরে ধীরে তিনি তার আয় দ্বারা একটি কুঠার কিনলেন। এরপর আরো কিছু দিনের আয় জমা করে কয়েকটি পশু ও ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনলেন। কিন্তু তিনি বনে গিয়ে কাঠ কেটে আনা ও বিক্রি করা চালিয়ে যেতে থাকলেন। এভাবে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি একজন ধনী ব্যবসায়ী হয়ে গেলেন।  

এরপর একদিন রাসূলে আকরাম (সা.) তাঁর কাছে গেলেন তিনি। রাসূলেখোদা তাকে দেখে মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘কি- আমি বলিনি?- "যে ব্যক্তি আমার নিকট সাহায্য চাইবে আমি তাকে সাহায্য করব। কিন্তু যদি কোন লোক অপরের সামনে হাত পাতা থেকে বেঁচে থাকে তাহলে মহান আল্লাহ তাকে অপরের মুখাপেক্ষী হওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখেন।"

বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে একটি নাতে রাসূল। এটির কথা ও সুর- তোফাজ্জল হোসেন খানের আর গেয়েছে শিশুশিল্প জাইমা নূর।

(অডিও ফাইল)

জাইমা নূরে দরদমাখা কণ্ঠে নাতে রাসূলটি শুনলে। বন্ধুরা, এবারের রয়েছে বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে উপদেশ প্রার্থী এক ব্যক্তির একটি সত্য ঘটনা।

এক আরব বেদুঈন মদীনা শহরে এসে রাসূলে আকরাম (সা.)-এর খেদমতে হাজির হয়ে বলল: ‘হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমাকে কিছু উপদেশ দান করুন’। মহানবী বললেন: ‘ক্রোধান্বিত হয়ো না’।  

একথা শুনে লোকটি তার গোত্রের মাঝে ফিরে গেল। বাড়ি ফিরেই সে জানতে পারল যে, তার অনুপস্থিতিতে এক মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে। তারই গোত্রের যুবকরা অপর এক গোত্রের কিছু মালামাল জোরপূর্বক লুটপাট করে নিয়ে এসেছে। এর জবাবে সে গোত্রের লোকেরাও এদের অনেক মালামাল লুটপাট করে নিয়ে গেছে। এভাবে লুটপাটের এ ধারা উভয় গোত্রের মাঝে এমন এক পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়েছে যে, এখন দুই গোত্রের লোকেরাই এক মারাত্মক যুদ্ধ-বিগ্রহ ও খুনাখুনির পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।

এ খবর শোনা মাত্রই সে লোকটি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ সে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলো এবং রণাঙ্গনের দিকে ছুটলো নিজের গোত্রের সঙ্গ দেবার জন্য।

ঠিক এমন সময় তার মনে পড়ল যে, সে মদীনায় গিয়েছিল এবং রাসূলে আকরাম (সা.)-এর কাছে উপদেশ প্রার্থনা করেছিল, তখন মহানবী (সা.) বলেছিলেন: ‘নিজের ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণে রাখো’।

এ সময় লোকটি মনে মনে ভাবতে লাগল: ‘কেন আমি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলাম? কোন্‌ কারণে আমি এভাবে যুদ্ধ করতে এবং খুনাখুনি করতে তৈরি হয়ে গেলাম? কেনইবা আমি এরূপ ক্রোধান্বিত হয়ে গেলাম’?

এসব প্রশ্ন তার মনে জেগে ওঠার পর সে ভাবল: ‘এখনই উপযুক্ত সময়, রাসুলুল্লাহর ছোট্ট উপদেশটি পালন করার।

এরপর সে এগিয়ে গেল এবং বিরোধী গোত্রের সরদারকে ডেকে বলল: এ সংঘাত কী জন্যে? যদি এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য হয় সে সমস্ত মালামাল ফিরে পাওয়া- যা আমাদের গোত্রের যুবকরা বোকামি করে তোমাদের থেকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে, তাহলে এসো আমি আমার নিজস্ব সম্পদ থেকে তোমাদের ক্ষতিপূরণ করে দেই। এটা একটা ভালো কথা নয় যে, এর কারণে আমরা একে অপরের রক্তপিপাসু হয়ে যাবো।’

প্রতিপক্ষ গোত্রের লোকেরা যখন এ ব্যক্তির যুক্তিপূর্ণ ও উদারতাপূর্ণ কথাগুলো শুনলো তখন তাদের মধ্যেও বীরত্ববোধ জেগে উঠলো। বলল: "আমরাও তোমাদের চেয়ে কোনো অংশে কম নই। যুবকরা কিছু মালামাল নাহয় ভুল করেই নিয়েছে তাই বলে আমরা ক্ষতিপূরণ নেবো? শুনে রাখো- আমরা আমাদের দাবি প্রত্যাহার করলাম।"  

একথা শুনে তখন উভয় গোত্রের লোকেরা নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেল। 'ক্রোধান্বিত হয়ো না' রাসূলেখোদার এই একটি বাণীই বড় ধরনের সংঘাত থেকে দুটি গোত্রকে বাঁচিয়ে দিল।

বন্ধুরা, দেখতে দেখতে আমাদের আজকের সব আয়োজন শেষ হয়ে এসেছে। তোমরা সবাই ভালো ও সুস্থ থেকো- এ কামনায় গুটিয়ে নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর। কথা হবে আবারো আগামী আসরে।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/মো.আবুসাঈদ/১৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ