জুন ১৫, ২০২২ ২০:২০ Asia/Dhaka

আজ আমরা এই মহান ইমামের আরো কিছু বক্তব্যসহ যুদ্ধের ময়দানে ইরানি শিবিরগুলোর আধ্যাত্মিক পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করব। বেশিরভাগ মানুষের কাছে যুদ্ধ একটি ঘৃণা উদ্রেককারী শব্দ। মানুষ এ যাবত তার নিজ প্রজাতির বিরুদ্ধে যত হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসলীলা চালিয়েছে অন্য কোনো প্রাণী তা চালায়নি।

যেকোনো যুদ্ধে অগণিত মানুষের মৃত্যু ছাড়াও অসংখ্য শিশু এতিম হয়, অসংখ্য নারী বিধবা হয় এবং অগুণতি মানুষ পঙ্গু হয়ে সারাজীবনের জন্য পরনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকে।  তারপরও এক মানুষ অপর মানুষের ওপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে আজও যুদ্ধ করে যাচ্ছে। যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষের প্রতি মানুষের বিদ্বেষ যেমন চরমে পৌঁছে তেমনি নিজেদের মধ্যে দয়া ও সহানুভূতিরও চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। মানুষের নরম ও গরম অনুভূতির এই বহিঃপ্রকাশের বিষয়টিকে উপজীব্য করে নানা যুগে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে।  ১৯৮০ সালের গ্রীষ্মকালে ইরাকের তৎকালীন স্বৈরশাসক সাদ্দাম ইরানের ওপর যে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল তার ফলে একদিকে যেমন ব্যাপক ধ্বংসলীলা সাধিত হয়েছে তেমনি এই যুদ্ধ থেকে সৃষ্টি হয়েছে অনেক বড় বড় সাহিত্য, তৈরি হয়েছে অনেক ভুবন বিখ্যাত সিনেমা।

আট বছরের প্রতিরক্ষা যুদ্ধের মর্যাদা ইরানের ইসলামি বিপ্লবের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। ইরানের তরুণ ও যুব সমাজের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী মুক্তিকামী আন্দোলনগুলোর ওপর এই যুদ্ধ অনেক গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছিল। ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) ১৯৮৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ সম্পর্কে এক বাণীতে বলেন, “প্রতিদিন আমরা যুদ্ধ থেকে কিছু না কিছু অর্জন করেছি এবং তা নানা ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছি। আমরা এই যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ইসলামি বিপ্লব ছড়িয়ে দিয়েছি। আমরা এ যুদ্ধে আগ্রাসী শক্তির অন্যায় আচরণ ও আমাদের অসহায়ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা শত্রু  ও বন্ধুদের চিনতে পেরেছি। আমরা এ যুদ্ধে একথা উপলব্ধি করেছি যে, আমাদেরকে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমরা এ যুদ্ধে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তির দম্ভ চুরমার করে দিয়েছি। আমরা এ যুদ্ধে ইসলামি বিপ্লবের শেকড় দৃঢ়কঠিন করতে পেরেছি। ”

ইমাম খোমেনী আরো বলেন, “আমরা এ যুদ্ধের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে দেশপ্রেম ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তুলেছি। আমরা গোটা বিশ্ববাসীকে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের শাসকদের একথা বোঝাতে পেরেছি যে, বিশ্বের সকল পরাশক্তির বিরুদ্ধে গিয়েও দেশরক্ষার যুদ্ধ  বছরের পর বছর ধরে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমাদের এ যুদ্ধ আফগানিস্তানকে স্বাধীন হতে সাহায্য করেছে এবং একদিন তা ফিলিস্তিনকেও স্বাধীন করতে সাহায্য করবে। আমাদের এ যুদ্ধের কারণে ইসলামবিরোধী সকল শক্তি ইসলামের সামনে নিজেদেরকে অসহায় ভেবেছে। এই যুদ্ধের কারণে আমাদের প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। আর সবকিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই যুদ্ধের কারণে ইসলামি বিপ্লবের স্থায়ীত্ব নিশ্চিত হয়েছে। ”

ইমাম খোমেনী (রহ.) পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের যেসব অর্জনের কথা বলেছেন তা সম্ভব হয়েছিল যুদ্ধের ময়দানে ইরানি যোদ্ধাদের আধ্যাত্মিক চেতনা, একনিষ্ঠতা ও আত্মত্যাগের মানসিকতার কারণে। বিশ্বের অন্যান্য যুদ্ধের সঙ্গে ইরাকের আট বছরের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের প্রধান পার্থক্যই ছিল যুদ্ধের ময়দানের আধ্যাত্মিক পরিবেশ। এমনকি ইরাকে ইরানি যুদ্ধবন্দিদের শিবিরেও এই আধ্যাত্মিক পরিবেশ ছিল চোখে পড়ার মতো।  বীরত্ব ও আত্মত্যাগ সাধারণত প্রায় সব যুদ্ধেই দেখা যায়। হলিউডসহ ইউরোপে তৈরি বিভিন্ন সিনেমায় তাদের যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়। কিন্তু ইরানের ওপর ইরাকের চাপিয়ে দেওয়া আট বছরের যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধারা আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তার তুলনা মেলা ভার। ইরাকি বাহিনীর সীমাহীন অন্যায় ও সহিংস আচরণের বিরুদ্ধে দেশরক্ষা করার যে সুমহান লক্ষ্য ইরানি যোদ্ধারা নির্ধারণ করেছিলেন এবং সে লক্ষ্য অর্জনে তারা যে সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন ইতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া যায় না।

আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি সৈন্যরা আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে এতটা উন্নতি অর্জন করেছিলেন যে, তাদের প্রত্যেকে বলতে গেলে সে যুগের একেকজন বড় আরেফ ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, অনেক যুবক যুদ্ধে যেত আত্মসংশোধন ও আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন করার সুমহান লক্ষ্য নিয়ে। যুদ্ধের ময়দানে ইরানি যোদ্ধাদের নামাজ, দোয়া ও মোনাজাতসহ অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি দেখলে যে কারো মনে হতো, সে হয়তো কোনো ইবাদতগৃহে চলে এসেছে যুদ্ধক্ষেত্রে নয়।

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এ সম্পর্কে বলেন, “যুদ্ধের সেই মহান দিনগুলোর স্মৃতি যেন আমাদের জাতীয় জীবন থেকে হারিয়ে না যায় সে চেষ্টা করতে হবে। পবিত্র কুরআনও আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে, আমরা এই দিনগুলোর কথা স্মরণে রাখব। আপনারা দেখুন হযরত মূসা (আ.) ও হযরত ইব্রাহিম (আ.)সহ অন্যান্য নবীদের কাহিনী পবিত্র কুরআনে কতবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। মানুষের স্মৃতি থেকে যেন এসব ঘটনা হারিয়ে না যায় সেজন্যই এটি করা হয়েছে। ”

আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ ছিল ইরানসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভাগ্য নির্ধারণের যুদ্ধ। লেবানন ও ফিলিস্তিনে আজ যে প্রতিরোধ সংগ্রাম চলছে তাতে ইরানের প্রতিরক্ষা যুদ্ধ থেকে আদর্শ গ্রহণ করা হয়েছে। পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের মূল্যবোধগুলোর বিকাশ ঘটাতে পারলে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো সম্ভব হবে। আট বছরের ওই যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধাদের অন্তরাত্মার পরিশুদ্ধতা বিশ্বের আর কোনো যুদ্ধের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ