জুলাই ১৭, ২০২২ ২১:০৩ Asia/Dhaka

ইসলামি বিপ্লবের আগে ইরানের জনগণের মধ্যে স্বৈরাচারী শাহ সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে একটি জাতীয় ঐক্যমত্য তৈরি হয়েছিল।

বিপ্লবের মাধ্যমে ওই পরনির্ভরশীল সরকার উৎখাতের পর দেশে একটি ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে জনগণের মধ্যে সে ঐক্য ও সংহতি অব্যাহত থাকে। আর এই অপূর্ব ও নজিরবিহীন ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর মতো একজন দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাবান নেতার অনন্য নেতৃত্বের কল্যাণে। এই মহান নেতার নেতৃত্বে ইরানি জনগণের মধ্যে যখন বিপ্লব পরবর্তী রাষ্ট্র পুনর্গঠনের জন্য শীশাঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্য বিদ্যমান, তখন ইরাকি স্বৈরশাসক সাদ্দাম ইরানে হামলা চালানোর ধৃষ্টতা দেখায়। বিপ্লব বিজয়ের মাত্র ১৯ মাস পর সাদ্দাম বাহিনী যখন ইরানে আগ্রাসন চালায় তখন ইসলামি শাসনব্যবস্থার ভিত্তি ততটা মজবুত হয়নি এবং এদেশের সেনাবাহিনীও ছিল অনেকটা ভঙ্গুর অবস্থায়।

এ সময় ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থার শত্রুরা তেহরানের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের লেলিয়ে দেয়। সেইসঙ্গে চলে ইরাকি বাহিনীর আগ্রাসন। ইরাকি বাহিনী ইরানে এই পরিকল্পনা নিয়ে অকস্যাৎ আগ্রাসন চালায় যে, তারা কয়েক দিনের মধ্যে তেহরান দখল করে ফেলবে। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিশিষ্ট কৌশলবিদ হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৮০ সালের ২৯ আগস্ট এক ভবিষ্যদ্বাণীতে বলেন, ইরাক মাত্র ১০ দিনে ইরান দখল করে ফেলতে পারবে। ফ্রান্সে আশ্রয় গ্রহণকারী ইরানের সাবেক শাহ সরকারের শেষ প্রধানমন্ত্রী শাপুর বখতিয়ার একই দিন বলেন, ইরাকের হাতে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ইরানের পতন হবে। আর ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন যুদ্ধের প্রথম দিন ঘোষণা করেন, তিনি সাত দিনের মাথায় তেহরানে বসে চা পান করবেন। কিন্তু ইরানি যুব সমাজ ন্যুনতম সমরাস্ত্র নিয়ে দেশরক্ষায় আত্মনিয়োগ করে এসব ভবিষ্যদ্বাণীর সবগুলো ব্যর্থ করে দেন।

ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) ইরাকি বাহিনীর এই আগ্রাসনকে ইরানি জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার সুযোগ হিসেবে কাজে লাগান। যেকোনো যুদ্ধে বিজয়ের জন্য নেতৃত্ব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  ইরাক-ইরান যুদ্ধে ইমাম খোমেনীর আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ও প্রজ্ঞাপূর্ণ নেতৃত্ব অস্ত্রসস্ত্র ও অভিজ্ঞতায় অসম অবস্থানে থাকা ইরানকে বিজয় এনে দেয়। গোটা ইরানি জাতি বিশেষ করে তরুণ যোদ্ধারা ইমামের প্রতি যে ভালোবাসা ও অন্ধ বিশ্বাস দেখিয়েছিল তা সম্ভব হয়েছিল তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে। চাপিয়ে দেওয়া এ যুদ্ধকে ইমাম খোমেনী (রহ.) ইরানি জনগণের জন্য পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে রূপান্তরিত করেন। তিনি নিজের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব দিয়ে ইরানের হাজার হাজার তরুণকে ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের মোহ থেকে ছিন্ন করে পরকালীন চিরস্থায়ী আবাসের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলেন। তিনি ইসলামের সমৃদ্ধ শিক্ষা তুলে ধরে তাদেরকে একথা বোঝাতে সক্ষম হন যে, ইসলামি ভূখণ্ড রক্ষার যুদ্ধে আত্মনিয়োগ করে শাহাদাতবরণ করলে আল্লাহর কাছে উচ্চ মর্যাদা লাভ করা যায়।  

ইমামের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার তরুণ যখন পাগলপারা হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন বিশ্বের বাঘা বাঘা রণকৌশলবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হতভম্ভ হয়ে যান। ইরানি যোদ্ধারা ইমাম খোমেনীকে দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতা ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে গ্রহণ করার পাশাপাশি ধর্মীয় নেতা হিসেবে তাঁর নির্দেশ পালনকে নিজেদের জন্য অবশ্যপালনীয় ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করে। প্রখ্যাত মার্কিন নৃবিজ্ঞানী মাইকেল ফিশার ইমাম খোমেনীর জনপ্রিয়তা ও জনগণের ওপর তার প্রভাব সম্পর্কে বলেন: ইমাম খোমেনীর বিপ্লব এমনকি মানুষের বিবর্তনের ধারাকেও পাল্টে দেয়; ফলে গোটা বিশ্ববাসী তাঁর আধ্যাত্মিক বিপ্লবের গুণমুগ্ধ ভক্তে পরিণত হয়। বিশ্বের কোনো রাজনৈতিক নেতা এ দাবি করতে পারবে না যে, জনগণের সঙ্গে তাদের এরকম একটি আধ্যাত্মিক বন্ধন তৈরি হয়েছে।

বিশিষ্ট মার্কিন মুসলিম চিন্তাবিদ হামিদ আলগার বলেন: ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সমস্ত সাফল্যের মূলে ছিল ইমাম খোমেনীর প্রতি মানুষের অন্ধ বিশ্বাস ও পরিপূর্ণ সমর্থন। কাজেই বলা যায়, ইরাকের বিরুদ্ধে ইরানের যুদ্ধে তেহরানের সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গাটি ছিল ইমাম খোমেনীর আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব। ইমাম ইরানের ওপর ইরাকে আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট হুমকিকে সুযোগে পরিণত করেন। যে আগ্রাসনের ফলে ইরানের নবগঠিত ইসলামি শাসনব্যবস্থার পতন ঘটতে পারত, তিনি সে আগ্রাসনকে এই শাসনব্যবস্থার ভিত্তি শক্তিশালী করার কাজে লাগান। ইমামের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১২ বছরের কিশোর থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত সব মানুষ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে নিজেদের প্রস্তুতি ঘোষণা করেন। এভাবে ইমাম আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর সম্ভাব্য বিজয়কে তাদের জন্য পরাজয়ের দুঃস্বপ্নে পরিণত করেন। আর তাও এমন এক সময় যখন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তি সাদ্দাম বাহিনীর জন্য সব ধরনের সহযোগিতার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিল।   

ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বিজয় বিশ্বের তৎকালীন দুই পরাশক্তির অন্তরে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭৯ সালের ১‌১ ফেব্রুয়ারি যখন ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয় লাভ করে তখন বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আমেরিকা ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধের উত্তেজনা চরমে পৌঁছে গিয়েছিল। সে সময় বিশ্বের যেকোনো দেশে যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে প্রাচ্য অথবা পাশ্চাত্যের কোনো এক পরাশক্তির সমর্থন বা শত্রুতার মাণদণ্ডে পরিমাপ করা হতো। কিন্তু ইরানের ইসলামি বিপ্লব দুই পরাশক্তিকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিজয় লাভ করে যা তৎকালীন বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ব্লক যখন প্রাচ্যের সমর্থনপুষ্ট সাদ্দাম সরকারের প্রতি সব ধরনের সহযোগিতার দ্বার অবারিত করে দেয় তখন ইমাম খোমেনী এ যুদ্ধকে হক ও বাতিলের এবং ইসলাম ও কুফরের মধ্যে যুদ্ধ বলে অভিহিত করেন।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ