জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইরানিদের অবদান - দুই
গত পর্বের আসরে আমরা খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দিতে ইরানের খ্যাতনামা চিকিৎসা বিজ্ঞানী, রসায়নবিদ ও দার্শনিক মোহাম্মদ জাকারিয়া রাজির কথা উল্লেখ করেছিলাম।
তার আবিষ্কারের মধ্যে অ্যালকোহল, এসিড সালফিউরিক, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, সাইট্রিক এসিডের কথা উল্লেখ করা যায়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর দশটিরও বেশী গ্রন্থ আছে মোহাম্মদ জাকারিয়া রাজির । অনুবাদ এর বদৌলতে তার চিকিৎসা বিদ্যা সংক্রান্ত গ্রন্থাবলী এবং ধ্যান-ধারণা মধ্যযুগের ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তাঁর রচিত বেশ কিছু বই পাশ্চাত্যের চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হতো। আল-রাজীর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে আল কিতাব আল হাওয়ী, দি ভারচুয়ালস লাইফ, আল জুদারী আল হাজবা, দ্যা ইসপিরিচ্যুয়াল ফিজিক্স, আল মানসুরী প্রভৃতি। খ্যাতনামা গবেষক জর্জ শার্টন মোহাম্মদ জাকারিয়া রাজিকে তৎকালীন সময়ের অনেক বড় মাপের চিকিৎসক হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, ধারণা করা হয় ইবনে সিনা তার 'কানুন' গ্রন্থটি রচনার ক্ষেত্রে আল রাজির লিখিত 'আল কিতাব আল হাওয়ী'র গ্রন্থ থেকে প্রেরণা লাভ করেছেন।
ইরানের খ্যাতনামা গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ ছিলেন আবদুর রহমান আল-সুফী। তিনিই প্রথম টেলিস্কোপ ছাড়াই একটি গ্যালাক্সির অস্তিত্বের বিষয়টি প্রমাণ করেছিলেন। তিনিই প্রথম ৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিটি পর্যবেক্ষণ করেন এবং এটিকে তিনি একটি ছোট মেঘ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।
ইরানের আরেক খ্যাতনামা দার্শনিক ও রসায়নবিদ হচ্ছেন জাবের বিন হাইয়ান যিনি একাধারে রসায়নবিদ ও আলকেমিবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও জ্যোতিষী, প্রকৌশলী, দার্শনিক, পদার্থবিজ্ঞানী এবং ঔষধ বিশারদ ও চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত। তাকে 'রসায়নের জনক' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি রসায়ন গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন এবং এমন কিছু আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা থেকে আজো রসায়ন বিশেষজ্ঞরা উপকৃত হচ্ছেন।

ইরানের আরেক খ্যাতনামা মনীষী হচ্ছেন ইবনে হিশাম। তিনি আবু আলী হাসান ইবনে হিশাম বাসরি নামে পরিচিতি ছিলেন। তিনি হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত মুসলিম গণিতবিদ এবং পদার্থবিজ্ঞানী। ইবনে হিশাম ছিলেন ফটোলজির জনক। ফটোলজি বিদ্যাকে তিনি সুশৃঙ্খল রূপ দেন। আলো নিয়ে এবং ছায়া নিয়ে তিনি ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছেন। অন্ধকার কক্ষের বৈশিষ্ট্য নিয়েও তিনি অনেক গবেষণা করেছেন। একইভাবে তিনি আলোর প্রতিফলনের নিয়মের ক্ষেত্রে চমৎকার কিছু পর্যালোচনা করেছেন। সমতল বা কনভেক্স অর্থাৎ স্ফীত লেন্সকে বড়ো করে দেখানোর বিষয়টিকে পরিমাপ করেছেন।
বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ মনে করেন, জ্ঞানবিজ্ঞান ও মানব সভ্যতার উন্নয়ন ও বিকাশে ইরানি সভ্যতার কাছে সবাই ঋণী। 'ইরানি মনীষী ও মনীষা' শীর্ষক নতুন এ ধারাবাহিক অনুষ্ঠানে আমরা জ্ঞানবিজ্ঞানে ইরানি মনীষীদের অবদান ও তাদের জীবন বৃত্তান্ত আপনাদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
আমাদের এটা জেনে রাখা ভালো কোনো কোনো দেশ বিশ্বের জাতিগুলোকে দুই অংশ ভাগ করেছে। এক অংশে রয়েছে উন্নত সভ্যতার অধিকারী তথা জ্ঞানবিজ্ঞানে এগিয়ে থাকা জাতি আর অন্য অংশে রয়েছে অনুন্নত বা পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠী। এমনকি পিছিয়ে পড়া জাতির ইতিহাস ঐতিহ্যকে খাটো করে দেখানোরও চেষ্টা চালানো হয়। শুরুতেই এমন আচরণ করা হয় যাতে একজন জ্ঞানী ব্যক্তির জাতীয়তা সম্পর্কে কেউ জানতে না পারে। কখনো কখনো ওই জাতির গবেষণাকর্ম ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। ১৭শ' এবং ১৮ শ' শতকে এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। যে কোনো জ্ঞান ও আবিষ্কারকে যদি আমরা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে মেনে নেই তাহলে জ্ঞান সবসময় মানুষের সাথি হয়েই থাকবে।
প্রায় এক হাজার বছর আগে ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় কেরমান শাহ ও হামেদান প্রদেশের কাছাকাছি অঞ্চলে যারা বসবাস করতো তারা বর্তমান যুগের মানুষের মতোই মানুষের জীবনকে আরো সহজতর করা এবং উন্নত সভ্যতা গড়ে তোলার জন্য প্রচেষ্টা চালাতেন। গণিতশাস্ত্রসহ অন্যান্য জ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে আজকে ইরানের যে শক্তিশালী অবস্থান তা অতীতে ইরানের জগতবিখ্যাত বিজ্ঞানীদের নানা আবিষ্কার, গবেষণা ও প্রচেষ্টারই ফসল মাত্র। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন জাতির কমবেশী ভূমিকা ছিল। তারা সবাই নিজেদের জ্ঞানীগুণি ব্যক্তিদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে জীবনমান উন্নয়ন ও বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ বা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করেছে। গণিতশাস্ত্র ও পরিমাপক পদ্ধতি সবসময়ই মানব জীবনের অংশ ছিল। দেখা যাবে বিশ্বে মানব সভ্যতার যে বয়স গণিতের বয়সও ঠিক ততখানি।
প্রাচীন যুগে হিসাব নিকাশের জন্য অর্থবোধক কোনো সংখ্যার ব্যবহার ছিল না। তবে পরবর্তীতে ভবন নির্মাণ, পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রভৃতি কাজে বিশেষ পরিমাপক যন্ত্র ও হিসাব নিকাশের জন্য বিশেষ পদ্ধতি বা হাতিয়ারের ব্যবহার ছিল এবং তাতে সীমিত পরিসরে গণিতের ব্যবহার ছিল। উদাহরণ স্বরূপ, ইরানে হাখামানেশিয় যুগে তৈরি প্রাসাদ ও ঘরবাড়ি নির্মাণ, রাজা বাদশাহদের চলাচলের জন্য বিশেষ সড়ক নির্মাণ, ম্যাপ তৈরি, জাহাজ নির্মাণ, দুই চাকার গাড়ি নির্মাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে গণিতের ব্যবহার ছিল লক্ষণীয়। ইরানের প্রাচীন শুশ নগরীতে বীজগণিতের সমীকরণ এবং বীজগণিত সারণীর মতো গণিতশাস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ইরানি বিজ্ঞানীরা পরিমাপের একক আবিষ্কারের কারণে ওই যুগে বিভিন্ন স্কেলের সহায়তায় বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার আয়তন পরিমাপ করতে পারতো। এ থেকে বোঝা যায় ওই যুগেও ইরানিদের জ্যামিতি জ্ঞান ছিল। বস্তুর আয়তন নির্ধারণ ও স্তর পরিমাপ বিষয়ক আইনে ইরানিরা ছিল খুবই পারদর্শী। তৎকালীন যুগে গ্রিসের বহু চিন্তাবিদ জ্যামিতি ক্ষেত্রে আরো অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ইরানিদের এ সংক্রান্ত জ্ঞানকে তারা কাজে লাগাতো।
উদাহরণ স্বরূপ, গ্রিস গণিতবিদ পিথাগোরাসের কথা উল্লেখ করা যায় যাকে জ্যামিতির জনক বলা হয়। তিনি প্রাচ্যের দেশগুলো সফর করে জ্যামিতিক উপপাদ্যের নিয়মকানুন সম্পর্কে অবহিত হন এবং গণিতশাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ এ শাখাকে নিজের নামে নথিভুক্ত করেন। অথচ ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণে দেখা যায়, ইরানের প্রাচীন শুশ অঞ্চলের জ্যামিতিবিদরা উপপাদ্যের বিষয়ে অবহিত ছিলেন যদিও তারা সে সংক্রান্ত জ্ঞান সবার সামনে তুলে ধরতে পারেননি।#
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/মো.আবুসাঈদ/২১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।