জুলাই ২৫, ২০২২ ২০:২৫ Asia/Dhaka
  • আফগানিস্তানে উগ্র সালাফি গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তারের রহস্য: পর্ব-ছয় (শেষ পর্ব)

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আল কায়দা ও তালেবান দমনের অজুহাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ব্যাপক হামলা চালিয়ে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের পতন ঘটায়। তখন থেকে আফগানিস্তানের নতুন যাত্রা শুরু হয়।

তালেবান পরবর্তী সরকারগুলো সেদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংঘাত ও উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু তাদের সরকারের প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি, পাশ্চাত্যের চাপিয়ে দেয়া এমন এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যার সঙ্গে আফগানদের স্থানীয় ধর্ম বিশ্বাস ও কৃষ্টির কোনো সম্পর্ক না থাকা, দরিদ্রতা, অর্থনৈতিক সংকট, বাইরের বিভিন্ন দেশের অযাচিত হস্তক্ষেপ, মার্কিন নেতৃত্বে আগ্রাসী বাহিনীর নির্বিচার বোমা বর্ষণ, বেসামরিক মানুষ হত্যা, ক্ষমতাসীনদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও অস্থিতিশীলতা প্রভৃতি কারণে আফগানিস্তানে ভয়াবহ ও কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় এবং জনমনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ।  

এর পাশাপাশি ধর্মীয় চরমপন্থার বিস্তার আফগানিস্তানের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। জিহাদের নামে কিংবা ধর্ম প্রচারণার নামে এসব গোষ্ঠী ওয়াহাবি সালাফি মতবাদ প্রচার করছে। আল কায়দা, হক্কানি, দায়েশ বা আইএস প্রভৃতি নামে এসব গোষ্ঠী আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে সক্রিয় রয়েছে যারা কিনা উগ্রবাদ বিস্তারে মূল ভূমিকা রাখছে এবং এদের সবার চিন্তাভাবনা, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশল প্রায় একই। উদাহরণ স্বরূপ, এরা সবাই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন ধ্বংস করার পক্ষপাতী এবং চরম শিয়া বিদ্বেষী। তারা সবাই নিজেদের নেতাকে আমির অথবা খলিফা বলে সম্বোধন করে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী সবাইকে ধর্মচ্যুত বলে মনে করে। এমনকি কাফের ফতোয়া দিতেও ছাড়েও না। তাদের বিশ্বাস তারা খোদার পক্ষ থেকে ধর্ম রক্ষার দায়িত্ব প্রাপ্ত। তারা ইরাক, সিরিয়া, খোরাসানসহ সমগ্র বিশ্বে ইসলামি শরীয়ত কায়েম করতে চায়। এ লক্ষ্যে দায়েশ বা আইএস জঙ্গিরা ইরাক ও সিরিয়ায় প্রভাব বিস্তারের পর আফগানিস্তানেও তারা খোরাসান শাখা নামে তৎপরতা শুরু করে। তালেবান ক্ষমতায় আসার আগেই তারা আফগানিস্তানের শিয়াদের ওপর ব্যাপক হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল।  

উগ্র গোষ্ঠীগুলোর ধর্মীয় নেতারা সৌদি আরবসহ বিভিন্ন আরব দেশে পড়ালেখা করেছে। এরা অন্য সবার চেয়ে অনেক বেশি কট্টর এবং শরীয়তের বিভিন্ন বিষয় প্রচার করাকে এরা অগ্রাধিকার দেয়। এদের লক্ষ্য অতটা স্পষ্ট নয় কিন্তু অন্য পক্ষের লক্ষ্য উদ্দেশ্য স্পষ্ট এবং তারা আফগান সরকারের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতো। আফগানিস্তানে দায়েশ বা আইএস জঙ্গিদের বিরোধিতা করা কিংবা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। বিশেষ করে আইএস জঙ্গিরা ইরাক ও সিরিয়ায় পরাজিত হওয়ার পর তারা আফগানিস্তানে সক্রিয় হয়ে উঠে এবং তাদেরকে আশরাফ গণি সরকার সমর্থন দিচ্ছিল বলে প্রায়ই খবর বের হতো। আফগানিস্তানে আইএস জঙ্গিদের উপস্থিতি ও তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আফগান সরকারকে দায়ী করা হতো। কেননা দায়েশের সাথে তালেবানের যুদ্ধকালে সরকার তালেবানের অবস্থানের ওপর বোমা হামলা চালাতো বলে অভিযোগ রয়েছে। অথবা এমন কাজ করতো যাতে দায়েশ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে না যায়।

তালেবান মুখপাত্র ও তাদের অন্যান্য কর্মকর্তারা ইরানের বহি:র্বিশ্ব কার্যক্রমের পশতু রেডিওকে দেয়া সাক্ষাতকারে বহুবার এ কথা বলেছেন যে, তালেবান যোদ্ধারা যখনই পূর্ব আফগানিস্তানে দায়েশ বা আইএস জঙ্গিদের পুরোপুরি ধ্বংসের একেবারে কাছাকাছি পর্যায়ে চলে যেত ঠিক তখনই আফগান সরকার বিমান হামলা চালিয়ে আইএস জঙ্গিদেরকে রক্ষা করেছে।

অন্যদিকে, আফগানিস্তানে মোতায়েন মার্কিন সেনারা আইএস জঙ্গিদেরকে পূর্ব ও দক্ষিণ আফগানিস্তান থেকে সরাসরি পশ্চিম আফগানিস্তানে স্থানান্তর করতো বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি সাবেক প্রেসিডেন্ট কারজাইও এসব ঘটনার কথা স্বীকার করেছেন। আফগানিস্তানের অন্যান্য কর্মকর্তারাও মার্কিন হেলিকপ্টারে করে এসব সন্ত্রাসীদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন।

ধারণা করা হচ্ছে, আমেরিকা ও তার মিত্ররা ইরাক ও সিরিয়ায় পরাজিত দায়েশ বা আইএস জঙ্গিদেরকে আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় মধ্যএশিয়ার দেশগুলোর সীমান্ত এলাকার দিকে স্থানান্তর করেছে। রাশিয়া প্রায়ই জঙ্গিদেরকে তাদের সীমান্ত এলাকার দিকে স্থানান্তরেরে ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এর প্রতিবাদ জানাতো। উদাহরণ হিসেবে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে জোরজান, সারপুল ও ফারিয়াব প্রদেশে দায়েশ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তালেবান যোদ্ধাদের ব্যাপক সামরিক অভিযানের কথা উল্লেখ করা যায়। এ অভিযান চলাকালে মার্কিন যুদ্ধ বিমানগুলো দায়েশ সন্ত্রাসীদের সমর্থনে তালেবান যোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ্য করে বোমা বর্ষণ করেছিলে। তবে ওই লড়াইয়ে বহু দায়েশ সন্ত্রাসী তালেবানের হাতে নিহত হয়েছিল এবং ১০০'র বেশি সদস্য গ্রেফতার হয়েছিল। কিন্তু আফগান সরকারের হেলিকপ্টার তালেবানের হাত থেকে অনেক সন্ত্রাসীকে উদ্ধার করে অন্যত্র স্থানান্তর করেছিল। এরপর আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে তালেবান যোদ্ধাদের সফল অভিযানের পর তারা গত আগস্টে দেশটির পূর্বাঞ্চলেও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান সম্প্রসারণ করে যা কিনা আমেরিকা ও ন্যাটো বাহিনীর তীব্র প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয় এবং মার্কিন বাধার কারণে তালেবানের সে অভিযান ব্যর্থ হয়।

তালেবানের প্রচণ্ড চাপের মুখে উগ্র গোষ্ঠীগুলো শেষ পর্যন্ত গোপনে সাধারণ মানুষের মধ্যে উগ্র ওয়াহাবি সালাফি মতবাদ প্রচারের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। সে সময়কার বিখ্যাত ধর্মপ্রচারক যেমন ড. আব্দুস সবুর  ফাখরি, মৌলভি আব্দুস সালাম, মৌলভি আবু উবায়দুল্লাহ প্রমুখ ব্যক্তিরা উগ্রবাদ প্রচারে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিল। আব্দুস সালাম সরাসরি বলতেন আমরা সবাই সালাফি কারণ সালাফিরাই বিশ্বনবী(সা.)এর প্রকৃত অনুসারী। আর শিয়াদের সম্পর্কে তিনি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচার করতেন।

পার্সটুডে/এমআরএইচ

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ