জুলাই ৩০, ২০২২ ১৯:১৬ Asia/Dhaka

শোকাবহ মহররম উপলক্ষে ইমাম হুসাইনের (আ) চিরঞ্জীব মহাবিপ্লব শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব থেকে সবাইকে জানাচ্ছি সংগ্রামী সালাম ও গভীর শোক আর সমবেদনা।

কীভাবে নবীর (সা.) উম্মতই নবীর (সা.) সন্তানকে হত্যা করলো (!)? -এ প্রশ্ন সব যুগের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের, যা খুবই স্বাভাবিক।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তিরোধানের মাত্র ৫০ বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই এ হত্যাকাণ্ড চালায় স্বয়ং রাসূলুল্লাহর (সা.) কথিত উম্মত যারা রাসূল এবং তাঁর বংশকে ভালবাসে বলে ধারণা করা হত। তাও আবার রাসূলের (সা.) সেইসব শত্রুর পতাকাতলে দাঁড়িয়ে মুসলমানরা রাসূলের (সা.) সন্তানের উপর এ হত্যাকাণ্ড চালায় যাদের সাথে রাসূলুল্লাহ (সা.)মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে যুদ্ধ করে গেছেন!  আসলে মক্কা বিজয়ের পর যখন চারদিকে ইসলামের জয়জয়কার তখন ইসলামের ঐ চির শত্রুরাও বাধ্য হয়েই নিজেদের গায়ে ইসলামের একটা লেবেল লাগিয়ে নেয়। তাই বলে ইসলামের সাথে তাদের শত্রুতার কোনো কমতি ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির বলেছিলেন-  “ তারা মুসলমান হয়নি, ইসলাম গ্রহণের ভান করেছিল মাত্র।”

আবু সুফিয়ান প্রায় ২০ বছর ধরে রাসূলুল্লাহর (সা.) সাথে যুদ্ধ করেছে। শুধু তাই নয়, শেষের দিকে ৫/৬ বছর সে ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ও ফেতনা সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দেয়। মোয়াবিয়াও তার পিতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইসলামের শত্রুতা করেছে। এভাবে আবু সুফিয়ানের দল তথা উমাইয়ারা ইসলামের চরম শত্রুতে পরিণত হয়। অথচ মহাবিস্ময় হল এই যে, রাসূলুল্লাহর (সা.) ওফাতের মাত্র দশ বছর পরে সেই মোয়াবিয়াই ইসলামী শাসনযন্ত্রের শীর্ষে আরোহণ করে শাম বা সিরিয়ার গভর্নর হয়ে বসে। আরও বিশ বছর পরে ইসলামের এই শত্রু  হয়ে বসলো স্বয়ং মুসলমানদের খলীফা! এখানেই শেষ নয়, রাসূলের (সা.) মৃত্যুর পর পঞ্চাশ বছর পর এবার মুসলমানদের খলীফা হল মোয়াবিয়া-পুত্র ইয়াজিদ। আর এই ইয়াজিদ নামায, রোযা, হজ্ব যাকাত তথা ইসলামের বিধি-বিধান পালনকারী মুসলমানদেরকে সাথে নিয়ে অর্ধ-শতাব্দী গড়াতে না গড়াতেই রাসূলের (সা.) সন্তানকে হত্যা করলো!

ইয়াজিদের সঙ্গী ঐ সব মুসলমানেরা যে ইসলামকে পরিত্যাগ করেছিল তা নয়, ইমাম হুসাইনের  (আ.) প্রতি তাদের শ্রদ্ধার অভাব ছিল তারও কোনো প্রমাণ মেলে না। কারণ, ইমাম হুসাইনের  (আ.) প্রতি বীতশ্রদ্ধ হলে তারা হয়তো বলতে পারতো যে,(নাউযুবিল্লাহ) ইমাম হুসাইন  (আ.) ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছেন। সুতরাং তাঁকে হত্যা করতে কোনো বাধা নেই। বরং তারা নিশ্চিতভাবে ইয়াজিদের ওপর ইমাম হুসাইনের (আ.) সহস্র গুণে শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদায়ও বিশ্বাস করতো। তাহলে কিভাবে মুসলিম শাসন-ক্ষমতা ইসলামের ঘোর শত্রু আবু সুফিয়ানের দলের হাতে পড়লো? এবং যে মুসলমানরা ইমাম হুসাইনের (আ.) রক্তের মূল্য যথার্থভাবে অবগত ছিল তারা কিভাবে ইমাম হুসাইনকে (আ.) হত্যা করলো? উমাইয়াদের মধ্যে প্রথমভাগে মুসলমান হবার গৌরব অর্জন করেছিল এবং ইসলামের প্রতি কোনো বিদ্বেষ পোষণ করতো না,বরং ইসলামের জন্যে অনেক অবদানই রেখেছিল এমন ব্যক্তির (অর্থাৎ ওসমানের) খলীফা পদ লাভই ছিল এর মূল কারণ। এর ফলেই উমাইয়ারা মুসলিম খেলাফত লাভের সুযোগ পায় প্রথমবারের মত।

উমাইয়ারা গোত্রবাদকে ব্যবহার করে ইসলামী শাসন ব্যবস্থাকে নিজেদের ব্যক্তিগত রাজত্বে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিল। স্বয়ং মারওয়ানই এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। অবশ্য দ্বিতীয় খলিফার শাসনামলেই মুয়াবিয়াকে শাম বা সিরিয়ার গভর্নর হিসেবে নিযুক্তির মাধ্যমে ইসলামী শাসনযন্ত্রে উমাইয়াদের উত্থান ঘটে। পরবর্তীতে অন্য সব গভর্নরের পদে রদবদল করা হলেও মুয়াবিয়াকে তার পদে বহাল রাখা হয়। এটাই ছিল মুসলিম শাসন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার মাধ্যমে উমাইয়াদের হীন বাসনা চরিতার্থকরণের পথে প্রথম অনুকূল ইঙ্গিত।-

উমাইয়ারা তৃতীয় খলিফা ওসমানের শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতি ছড়ায় ও গোলযোগ সৃষ্টি করে। এতে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং শেষ পর্যন্ত ওসমান নিহত হলে মোয়াবিয়া তার সে লালসা পূরণের মোক্ষম সুযোগ পায়। সে বলে বেড়ায়,‘যেহেতু ওসমানের হত্যার পর আলী (আ.) খলীফা হয়েছেন, আর ওসমানের হত্যাকারীদেরকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন-তাই ওসমান হত্যার জন্য মূলত আলীই (আ.) দায়ী।’ এই বলে সে কাঁদতে থাকে যাতে মানুষের অনুভূতিকে আকৃষ্ট করা যায়! তার এ প্রচেষ্টা সফলও হয়। ফলে অসতর্ক জনগণের অনেকেই মুয়াবিয়ার সহযোগী হতে রাজি হয়। এভাবে পদলোভী স্বার্থপর মোয়াবিয়া মুসলমানদেরকে নিয়েই ইসলামের বিরুদ্ধে বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলে। উমাইয়্যারা ইসলামপূর্ব যুগ হতেই ছিল মহানবীর বংশ তথা হাশিমি বংশের শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বী। মোয়াবিয়া উসমান হত্যার দাবি তুলে হযরত আলীর শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেও নিজে যখন খেলাফত দখল করে  ছলে-বলে কৌশলে তখন ওসমান হত্যার বিচারের আর কোনো উদ্যোগই নেয়নি! ওসমানকে বিদ্রোহীদের হাত থেকে রক্ষা করারও কোনো উদ্যোগ সে নেয়নি লাশের রাজনীতি করার স্বার্থেই!

 সিরিয়ায় হযরত আলীর বিরুদ্ধে মুয়াবিয়া এমন মিথ্যা প্রচার চালিয়েছিল যে সিরিয় জনগণ মনে করত হযরত আলী অত্যন্ত ধর্মহীন প্রকৃতির মানুষ! তারা যখন শোনে যে হযরত আলী কুফার মসজিদে নামাজ আদায়ের সময় শত্রুর আঘাত পেয়ে শহীদ হয়েছেন তখন বিস্মিত হয়ে তারা বলেছিল: আলী কি নামাজও পড়তেন নাকি! হযরত আলীর শাহাদাতের পর মুয়াবিয়া নিজের পথ পরিষ্কার করতে ইমাম হাসানকে বিষ প্রয়োগে শহীদ করে ও ইমাম হাসানের সঙ্গে যুদ্ধ-বিরতির চুক্তি লঙ্ঘন করে অযোগ্য, মদ্যপ ও লম্পট চরিত্রের অধিকারী পুত্র ইয়াজিদকে মুসলমানদের খলিফা করার উদ্যোগ নেয়। আর ইয়াজিদের মত প্রকাশ্য ফাসিক ও জালিমকে স্বীকৃতি দেয়া ইমাম হুসাইনের মত মহামানব ও ইমামের পক্ষে যে সম্ভব ছিল না তা যেমন স্পষ্ট এবং ইয়াজিদের হাতে যে ইসলামের বিলুপ্তি ঘটা অনিবার্য তা এই মহান ইমাম প্রকাশ্য দিবালোকের মত দেখতে পেলেও জনগণের এক বড় অংশই সে বিষয়ে সচেতন ছিল না!

ইমাম হুসাইন আশুরার দিন ইয়াজিদ বাহিনীকে প্রশ্ন করেছিলেন তোমরা কোন্ অপরাধে আমাকে হত্যা করতে চাও? তখন তারা বলেছিল তোমার কোনো দোষ না থাকলেও তোমার বাবার ওপর আমাদের রাগ আছে! তখন বাবার মাজলুমিয়াতের কথা স্মরণ করে ইমাম দুঃখ পেয়েছিলেন! ইয়াজিদ তো ইমাম হুসাইনের ছিন্ন মস্তকের সামনে কবিতা আবৃত্তি করে বলেছিল, ইস্ বদরে, ওহোদে ও অন্যান্য যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে আমাদের গোত্রের বা বংশের যারা নিহত হয়েছিল তারা যদি দেখতো যে মুহাম্মাদের ওপর আমরা কিভাবে প্রতিশোধ নিয়েছি! উল্লেখ্য বেশিরভাগ কাফের নেতা নিহত হয়েছিল হযরত আলীর হাতেই ইয়াজিদ সেদিকেই ইঙ্গিত করেছিল! জালিমদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ পড়ুক অজস্র ধারায়।#

পার্সটুডে/মু. আমির হুসাইন/মো.আবুসাঈদ/৩০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ