আগস্ট ১৪, ২০২২ ১৭:২৮ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা জারিয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির। মক্কায় অবতীর্ণ এ সূরায় পার্থিব জীবন ও পরকাল, সৃষ্টজগতে আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বের নির্দশন, কয়েকজন নবীর কাহিনী এবং পথভ্রষ্ট কিছু জাতির পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে। এই সূরার ১৫ থেকে ১৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

 إِنَّ الْمُتَّقِینَ فِی جَنَّاتٍ وَعُیُونٍ ﴿١٥﴾ آخِذِینَ مَا آتَاهُمْ رَبُّهُمْ إِنَّهُمْ کَانُوا قَبْلَ ذَلِکَ مُحْسِنِینَ ﴿١٦﴾ کَانُوا قَلِیلا مِنَ اللَّیْلِ مَا یَهْجَعُونَ ﴿١٧﴾ وَبِالأسْحَارِ هُمْ یَسْتَغْفِرُونَ ﴿١٨﴾ وَفِی أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ ﴿١٩﴾

“নিশ্চয় মুত্তাকীরা থাকবে জান্নাতসমূহে ও ঝর্ণাধারার [পাশে]।” (৫১:১৫)

“আর তাদের প্রতিপালক যা তাদেরকে দেবেন তা তারা গ্রহণ করবে, কারণ তারা এর পূর্বে [দুনিয়ার জীবনে] সবর্দা ছিল সৎকর্মশীল।” (৫১:১৬)

“তারা রাতের সামান্য অংশই অতিবাহিত করত নিদ্রায়।” (৫১:১৭)

“আর রাতের শেষ প্রহরে তারা [আল্লাহর কাছে] ক্ষমা প্রার্থনা করত।” (৫১:১৮)

“এবং তাদের ধন-সম্পদে ছিল [অভাবী] যাঞ্ঝাকারী ও বঞ্চিতদের অধিকার [যা তারা আদায় করত]।” (৫১:১৯)

মানুষকে হেদায়েত করার জন্য পবিত্র কুরআনের একটি সুন্দর পদ্ধতি হলো ভালো ও খারাপ মানুষের মধ্যে তুলনা করা। গত আসরে কিয়ামত অস্বীকারকারী পাপী লোকদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছিল। এরপর আজকের এই আয়াতগুলোতে সৎকর্মশীল মুত্তাকিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: এ ধরনের মানুষ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে। কারণ, তারা পার্থিব জীবনে আল্লাহর ইবাদত করার পাশাপাশি অভাবীদের দান করেছে।

এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, পরকালে অবিশ্বাসীদের অনেকেও তো পার্থিব জীবনে দান-খয়রাত করে। এর উত্তর হচ্ছে, আল্লাহর অস্তিত্ব ও পরকালে অবিশ্বাস করে যতই দান-খয়রাত করা হোক না কেন তাতে আল্লাহর কাছ থেকে কোনো প্রতিদান পাওয়া যাবে না।  এছাড়া, মুত্তাকিরা পৃথিবীতে শুধু দান-খয়রাতই করেনি সেইসঙ্গে দিনের পাশাপাশি গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে তখন আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে সময় কাটায়। অন্য কথায় তারা দিনের আলোয় অভাবীদের অভাবমোচন করে আর রাতে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে নিজেদের পাপমোচনের চেষ্টায় মগ্ন থাকে।

এই পাঁচ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১- পার্থিব জীবনে গোনাহ-মিশ্রিত আনন্দ উপভোগ ও বিনোদন থেকে বিরত থাকতে পারলেই কেবল পরকালে স্থায়ী সুখ উপভোগের সুযোগ পাওয়া যাবে।

২- পরকালীন জীবনে সফলতার দু’টি চাবিকাঠি হচ্ছে আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর দরবারে কান্নাকাটি করা এবং অভাবী ও বঞ্চিতদের দুঃখ দূর করা। অন্য কথায় ইবাদত ও দান একে অন্যের পরিপূরক এবং একটি ছাড়া অন্যটি অর্থহীন।

৩- রাতের একাংশে মধুর ঘুম ত্যাগ করে নফল নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত, জিকির-ইস্তিগফারে অতিবাহিত করা মুত্তাকিদের স্থায়ী বৈশিষ্ট্য।

৪- কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার শ্রেষ্ঠ সময় হচ্ছে ভোররাত।

৫- অভাবী ও বঞ্চিতদের যা দান করা হয় তা তাদের অধিকার। কারণ, আল্লাহই ধনিক শ্রেণির সম্পদে সে অধিকার রেখে দিয়েছেন। সে অধিকার অভাবীদের দুয়ারে পৌঁছে দিতে হবে এবং এজন্য তাদেরকে খোটা দেয়া যাবে না।

সূরা জারিয়াতের ২০ থেকে ২৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَفِی الأرْضِ آیَاتٌ لِلْمُوقِنِینَ ﴿٢٠﴾ وَفِی أَنْفُسِکُمْ أَفَلا تُبْصِرُونَ ﴿٢١﴾ وَفِی السَّمَاءِ رِزْقُکُمْ وَمَا تُوعَدُونَ ﴿٢٢﴾ فَوَرَبِّ السَّمَاءِ وَالأرْضِ إِنَّهُ لَحَقٌّ مِثْلَ مَا أَنَّکُمْ تَنْطِقُونَ ﴿٢٣﴾ 

“আর সুনিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্য যমীনে অনেক নিদর্শন রয়েছে।”(৫১:২০)

“আর [নিদর্শন আছে] তোমাদের [সৃষ্টির] মাঝেও, তোমরা কি দেখ না?” (৫১:২১)

“এবং তোমাদের রিযিক আর যার প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে তার [সবকিছু] আসমানে রয়েছে।”(৫১:২২)

“অতএব আসমান ও যমীনের রবের শপথ! নিশ্চয় তোমরা যে কথা বলে থাক তার মতই এই [কথা] সত্য।”(৫১:২৩)

আগের আয়াতগুলোতে কিয়ামতের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এরপর এই আয়াতগুলোতে আল্লাহর নিদর্শন প্রত্যক্ষ করার আহ্বান জানিয়ে বলা হচ্ছে: মানুষ কেন চোখ খুলে তাদের সৃষ্টি ও তাদের চারপাশের সৃষ্টজগত দেখে না? নবী-রাসূলদের দাওয়াতের সারকথা ছিল, ‘মান আরাফা নাফসা, ফাকাদ আরাফা রাব্বিহ’ অর্থাৎ যে নিজেকে চিনতে পেরেছে সে আল্লাহকে চিনেছে।

বর্তমানে জ্ঞানবিজ্ঞানের উৎকর্ষের যুগে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের রোগ ও তা সারিয়ে তোলার জন্য অবিরাম গবেষণা চলছে। পাশাপাশি মনরোগের ওপরও গবেষণার কমতি নেই। এসব গবেষণার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে চেনার চেষ্টা করছে। কিন্তু এত চেষ্টা-প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মানুষের অস্তিত্বের এমন বহু দিক রয়েছে যা তার অজানা। মানুষ এখনও একটি অজানা জীবই রয়ে গেছে।

মায়ের পেটে ভ্রূণ থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত একজন মানুষের বিভিন্ন পর্যায় এবং বড় বড় কাজ করার যে মেধা ও শারিরীক শক্তি তার মধ্যে সুপ্ত থাকে তা হচ্ছে মানুষ সৃষ্টির বিস্ময়কর রহস্য। আর এসব প্রমাণ করে, আল্লাহ তায়ালা মানুষের প্রতিটি প্রয়োজন জানেন এবং সেসবের সবগুলো তিনি পূরণের ব্যবস্থা করেছেন।  চোখ, কান ও দাঁতের মতো বাহ্যিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিংবা রক্ত চলাচল, পরিপাকতন্ত্র, শ্বাস-প্রশ্বাস ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ইত্যাদি সঠিকভাবে উপলব্ধি করার জন্য অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রয়োজন হয়। আর একজন মানুষের এসব অঙ্গপ্রতঙ্গ কিংবা শারিরীক ব্যবস্থার পুরোটা আয়ত্ব করা একজন চিকিৎসকের পক্ষে সম্ভব নয়। একেক চিকিৎসক একেকটি বিষয়ে বুৎপত্তি অর্জন করেন। কিন্তু এসব অঙ্গ ও ব্যবস্থার সমন্বয়ে একজন মানুষের শারিরীক সক্ষমতা কেবলমাত্র আল্লাহ তায়ালাই দান করেন।

অন্যদিকে যে পৃথিবীতে আমরা বসবাস করি সেটি মহাশূন্যে ভাসমান থেকেই নিজের অক্ষের উপর এবং সূর্যের চারপাশে প্রদক্ষিণ করছে।  হাজার হাজার বছর ধরে এভাবে ভাসমান থাকার পরও সূর্য থেকে পৃথিবী এক বিন্দু পরিমাণও দূরে সরে যায়নি বা কাছে আসেনি। এছাড়া, এই পৃথিবীতে নদী, পাহাড়, সাগর, গাছপালা- ইত্যাদি সবকিছু মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে। জমিন বা ভূপৃষ্ঠ হচ্ছে মানুষসহ অন্য সব প্রাণীর মায়ের মতো যেখান থেকে সব প্রাণী ও উদ্ভিদের খাদ্যের যোগান হয়। ভূপৃষ্ঠের একাংশ নরম হওয়ার কারণে সেখানে অসংখ্য শস্য ও উদ্ভিদ উৎপন্ন হয়। পাশাপাশি কঠিন পদার্থ দিয়ে তৈরি পাহাড়-পর্বতে রয়েছে নানারকম খনিজ সম্পদ যা দিয়েও মানুষ তার দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করতে পারে।

কোনো মানুষ যদি সতর্কতার সঙ্গে চারপাশের এতসব নিয়ামতরাজির দিকে নজর দেয় তাহলে সে এসবের স্রষ্টার অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পারে। সে একথা বুঝতে পারে যে, এতসব সৃষ্টির নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে এবং এসব উদ্দেশ্যের কথা আল্লাহ তায়ালাই মানুষকে ঐশী জ্ঞানের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। ওহী ছাড়া ইন্দ্রীয়লব্ধ জ্ঞান দ্বারা শত গবেষণা করেও বিশ্বজগত সৃষ্টির উদ্দেশ্য অনুধাবন করা সম্ভব নয়। মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য শেষ হয়ে যায় না বরং মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষের অনন্ত জীবন শুরু হয় মাত্র।

এই চার আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- পবিত্র কুরআনে আল্লাহকে চেনার জন্য বারবার পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নিদর্শনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জ্ঞানবিজ্ঞানের উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে এসব নিদর্শন উপলব্ধি করা মানুষের জন্য সহজ হচ্ছে।

২- আল্লাহকে চেনার সবচেয়ে ভালো উপায় নিজেকে চেনা। মানুষ নিজেকে চেনার মাধ্যমে আল্লাহকে চিনতে পারে।

৩- মানুষের রিজিকের উৎস আসমানে। আসমান ও জমিন একত্রে মিলে মানুষের রিজিকের ব্যবস্থা করে। আসমান থেকে আসা সূর্যের আলো, মেঘ, বাতাস ও বৃষ্টি জমিনের মাটিতে প্রাণ সঞ্চার করে এবং উভয়ে মিলে পৃথিবীর সকল প্রাণীর রিজিকের ব্যবস্থা করে।

৪- কথা বলতে পারা মানুষের প্রতি আল্লাহর একটি বিশেষ অনুগ্রহ। এ কারণে আজকের শেষ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রতিশ্রতির সত্যতা নিশ্চিত করার জন্য মানুষের কথা বলার উদাহরণ টেনেছেন।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ