আগস্ট ১৪, ২০২২ ১৭:৪১ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা জারিয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির। মক্কায় অবতীর্ণ এ সূরায় পার্থিব জীবন ও পরকাল, সৃষ্টজগতে আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বের নির্দশন, কয়েকজন নবীর কাহিনী এবং পথভ্রষ্ট কিছু জাতির পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে। এই সূরার ২৪ থেকে ৩০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

هَلْ أَتَاکَ حَدِیثُ ضَیْفِ إِبْرَاهِیمَ الْمُکْرَمِینَ ﴿٢٤﴾ إِذْ دَخَلُوا عَلَیْهِ فَقَالُوا سَلامًا قَالَ سَلامٌ قَوْمٌ مُنْکَرُونَ ﴿٢٥﴾ فَرَاغَ إِلَى أَهْلِهِ فَجَاءَ بِعِجْلٍ سَمِینٍ ﴿٢٦﴾ فَقَرَّبَهُ إِلَیْهِمْ قَالَ أَلا تَأْکُلُونَ ﴿٢٧﴾ فَأَوْجَسَ مِنْهُمْ خِیفَةً قَالُوا لا تَخَفْ وَبَشَّرُوهُ بِغُلامٍ عَلِیمٍ ﴿٢٨﴾ فَأَقْبَلَتِ امْرَأَتُهُ فِی صَرَّةٍ فَصَکَّتْ وَجْهَهَا وَقَالَتْ عَجُوزٌ عَقِیمٌ ﴿٢٩﴾ قَالُوا کَذَلِکَ قَالَ رَبُّکِ إِنَّهُ هُوَ الْحَکِیمُ الْعَلِیمُ ﴿٣٠﴾

“[হে রাসূল!] আপনার কাছে ইবরাহীমের সম্মানীত মেহমানদের বৃত্তান্ত এসেছে কি?”(৫১:২৪)

“যখন তারা তার কাছে উপস্থিত হয়ে বলল, [আপনাকে] সালাম। উত্তরে তিনি বললেন, [আপনাদেরকেও] ‘সালাম’। আপনারা তো অপরিচিত লোক।” (৫১:২৫)

“অতঃপর ইবরাহীম চুপিসারে তার পরিবারের কাছে গেলেন এবং একটি মোটা-তাজা গো-বাছুর (ভুনা করে) নিয়ে আসলেন।” (৫১:২৬)

“অতঃপর তিনি তাদের সামনে খাবার রাখলেন [কিন্তু বিস্মিত হয়ে যখন দেখলেন তারা খাবারে হাত বাড়াচ্ছে না। তখন তাদের] বললেন, তোমরা খাচ্ছ না কেন?!” (৫১:২৭)

“এতে [তার অন্তরে] তাদের সম্পর্কে ভীতির সঞ্চার হল।  তারা বলল, ভীত হবেন না! [আমরা ফেরেশতা!] আর তারা তাকে এক জ্ঞানী পুত্ৰ সন্তানের সুসংবাদ দিল।” (৫১:২৮)

“তখন ইব্রাহীমের স্ত্রী [সন্তানের সুসংবাদ শুনে] চিৎকার করতে করতে সম্মুখে আসল এবং তার গাল চাপড়িয়ে বলল, [আমার মতো] বৃদ্ধা-বন্ধ্যা [কীভাবে সন্তানের মা হবে?!]”(৫১:২৯)

 “তারা বলল, আপনার রব এরূপই বলেছেন এবং নিশ্চয় তিনি প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।”  (৫১:৩০)

এই আয়াতগুলোতে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর কাছে মানুষের রূপ ধারণ করে অপরিচিত ব্যক্তি হিসেবে ফেরেশতাদের আগমনের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। ফেরেশতারা দু’টি খবর জানাতে হযরত ইব্রাহীমের কাছে এসেছিলেন। এর একটি ছিল বৃদ্ধ বয়সে হযরত ইব্রাহীমকে সন্তানের সুসংবাদ এবং অন্যটি ছিল আল্লাহর অপর নবী হযরত লুত (আ.)-এর পাপাচারী জাতির ওপর আজাব নাজিলের দুঃসংবাদ।  বলা হচ্ছে, হযরত ইব্রাহীম তাদেরকে না চিনলেও তাদেরকে স্বাদরে গ্রহণ করেন এবং তাদের আপ্যায়নের জন্য একটি বাছুর জবাই করে তার গোশত ভুনা করে নিয়ে আসেন। 

আল্লাহর নবী যখন দেখেন অতিথিরা খাবার খাচ্ছে না তখন তিনি শঙ্কাবোধ করেন যে, তাদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই তো? কারণ, তখন ভদ্র সমাজে এই রীতি প্রচলিত ছিল যে, খাবার পেশ করলে অতিথিরা কিছু না কিছু খাবার গ্ৰহণ করবে।  কোন অতিথি তা না করলে তাকে ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে আগমনকারী শত্রু  বলে আশংকা করা হত। এ কারণে তিনি তাদের কাছে খাবার না খাওয়ার কারণ জানতে চাইলেন। উত্তরে তারা বলল- তারা আল্লাহর ফেরেশতা বলে খাবার খাচ্ছে না। কিন্তু ফেরেশতারা কেন শুরুতেই নিজেদের পরিচয় দেননি? পরিচয় দিলে তো হযরত ইব্রাহীমকে এতটা কষ্ট ও খরচ করে দামী খাবার প্রস্তুত করার প্রয়োজন হতো না।  এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে- হয়তো আল্লাহ তায়ালা এর মাধ্যমে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর অতিথিপরায়ণতা ও বদান্যতা তুলে ধরতে চেয়েছেন।  

যাই হোক, হযরত ইব্রাহীমের কষ্ট বিফলে যায়নি। ফেরেশতারা তাকে এই সুসংবাদ দেন যে, শিগগিরই আল্লাহ তায়ালা তাকে এমন একটি ছেলে সন্তান দান করবেন যিনি হবেন যুগশ্রেষ্ঠ আলেম ও জ্ঞানী। কিন্তু সে সময় আল্লাহর এই নবী ও তার স্ত্রী বন্ধ্যা ছিলেন। এ কারণে ফেরেশতাদের কথা শুনে হযরত ইব্রাহীমের স্ত্রী সারা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান এবং বলেন, প্রথমত, আমি বৃদ্ধা, এরপর বন্ধ্যা। যৌবনেই আমি সন্তান ধারণের যোগ্য ছিলাম না। এখন বার্ধক্যে এটা কিভাবে সম্ভব হবে? জবাবে ফেরেশতারা যা বললেন তার অর্থ, আল্লাহ তা'আলা সবকিছু করতে পারেন। এ কাজও এমনিভাবেই হবে।

এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- অতিথিপরায়ণতা নবী-রাসূলদের সুন্নত। সে অতিথি যতই অপরিচিতি হোক না কেন।

২- সালাম দেয়া এক ঐশী আদব এবং ফেরেশতারা পর্যন্ত সালাম দিয়ে তাদের কথা বলা শুরু করেন।

৩- অতিথি আপ্যায়ণের ক্ষেত্রে কৃপণতা না করে যথাসম্ভব ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা উচিত।

৪- নবী-রাসূলগণও মানুষ এবং আর দশটি মানুষের মানুষের মতো তাদেরও ভয় এবং শঙ্কা হয়।

৫- আল্লাহর ক্ষমতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই এবং সব প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের ঊর্ধ্বে। তিনি ইচ্ছা করলে বৃদ্ধা ও বন্ধ্যা দম্পতির ঘরেও সন্তান দান করতে পারেন। কাজেই কখনও কোনো অবস্থায় আল্লাহর দয়া ও রহমত থেকে নিরাশ হতে নেই।

সূরা জারিয়াতের ৩১ থেকে ৩৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

قَالَ فَمَا خَطْبُکُمْ أَیُّهَا الْمُرْسَلُونَ ﴿٣١﴾ قَالُوا إِنَّا أُرْسِلْنَا إِلَى قَوْمٍ مُجْرِمِینَ ﴿٣٢﴾ لِنُرْسِلَ عَلَیْهِمْ حِجَارَةً مِنْ طِینٍ ﴿٣٣﴾ مُسَوَّمَةً عِنْدَ رَبِّکَ لِلْمُسْرِفِینَ ﴿٣٤﴾ فَأَخْرَجْنَا مَنْ کَانَ فِیهَا مِنَ الْمُؤْمِنِینَ ﴿٣٥﴾ فَمَا وَجَدْنَا فِیهَا غَیْرَ بَیْتٍ مِنَ الْمُسْلِمِینَ ﴿٣٦﴾ وَتَرَکْنَا فِیهَا آیَةً لِلَّذِینَ یَخَافُونَ الْعَذَابَ الألِیمَ ﴿٣٧﴾

“[ইব্রাহীম] বলল: তাহলে হে প্রেরিত ফেরেশতাগণ! তোমরা যে কাজের জন্য এসেছ সে কাজটি কি?”(৫১: ৩১)

“তারা বলল: নিশ্চয় আমরা এক অপরাধী সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। ” (৫১: ৩২)

“যাতে [তাদেরকে ধ্বংস করার জন্য] তাদের উপর নিক্ষেপ করি মাটির শক্ত ঢেলা।” (৫১: ৩৩)

“যা আপনার রবের কাছে সীমালঙ্ঘনকারীদের [ধ্বংস করার] জন্য চিহ্নিত হয়ে আছে।”(৫১: ৩৪)

“অতঃপর সেখানে যেসব মুমিন ছিল আমরা তাদেরকে বের করে নিয়ে আসলাম।” (৫১: ৩৫)

“তবে আমরা সেখানে একটি পরিবার ছাড়া [অর্থাৎ লুত ও তার পরিবার ছাড়া] আর কোন মুসলিম পাইনি।” (৫১: ৩৬)

“আর যারা মর্মন্তুদ শাস্তিকে ভয় করে আমরা তাদের জন্য ওখানে একটি [শিক্ষামূলক] নিদর্শন রেখেছি।” (৫১: ৩৭)

আল্লাহর প্রেরিত ফেরেশতারা হযরত ইব্রাহীমকে সন্তানের সুসংবাদ দেয়ার পর বলেন, পৃথিবীতে তাদের আগমনের মূল লক্ষ্য লুত (আ.)-এর জাতিকে ধ্বংস করা। ওই জাতির মধ্যে সমকামিতার মতো নোংরা রীতি চালু ছিল এবং এই কাজকে তারা খারাপ মনে করত না। তারা এ ব্যাপারে হযরত লুত (আ.)-এর নিষেধও মানত না।

হযরত ইব্রাহীম (আ.)ই ওই জাতিকে হেদায়েত করার জন্য হযরত লুতকে সেখানে পাঠিয়েছিলেন। এ কারণে ফেরেশতারা বিষয়টি ইব্রাহিম (আ.)কে জানিয়ে নিজেদের কাজ শুরু করেন। তারা একথাও বলেন যে, এই আজাব থেকে হযরত লুত ও তাঁর মুমিন সঙ্গীরা বেঁচে যাবেন।

এবারে এই আয়াতগুলোর কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় জানিয়ে দিচ্ছি:

১- আল্লাহ তায়ালা শুধু পরকালে অপরাধীদের শাস্তি দেবেন না, বরং তিনি এই পৃথিবীতেই কোনো কোনো ব্যক্তি ও জাতিকে শাস্তি দেন ও ধ্বংস করেন।

২- পাপে ভরা সমাজে পাপ কাজ করার সব উপকরণ সহজলভ্য থাকে। কিন্তু তারপরও কেউ ইচ্ছা করলে এ ধরনের সমাজেও পাপমুক্ত জীবন কাটাতে পারে। কাজেই কেউ যেন নিজের পাপকে বৈধতা দেয়ার জন্য কলুষিত সমাজের অজুহাত না দেয়।

৩- আল্লাহর আইনে কোনো সমাজের বেশিরভাগ মানুষ পাপাচারী হয়ে গেলেও সেখানকার নিরপরাধ মানুষেরা পাপীদের অপরাধের শাস্তি ভোগ করেন না বরং তাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়।

৪- অতীতকালের পাপিষ্ঠ ও অপরাধী জাতিগুলোর ফেলে যাওয়া নিদর্শন ভবিষ্যত প্রজন্মগুলোর জন্য শিক্ষা যাতে তারা আল্লাহর অবাধ্য হওয়া থেকে বিরত থাকে।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ