আগস্ট ১৪, ২০২২ ১৮:১৬ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা জারিয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির। মক্কায় অবতীর্ণ এ সূরায় পার্থিব জীবন ও পরকাল, সৃষ্টজগতে আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বের নির্দশন, কয়েকজন নবীর কাহিনী এবং পথভ্রষ্ট কিছু জাতির পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে। এই সূরার ৫৪ থেকে ৫৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

فَتَوَلَّ عَنْهُمْ فَمَا أَنْتَ بِمَلُومٍ ﴿٥٤﴾ وَذَکِّرْ فَإِنَّ الذِّکْرَى تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِینَ ﴿٥٥﴾

“অতএব আপনি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন, এতে আপনি তিরস্কৃত হবেন না।” (৫১:৫৪)

“আর আপনি অনবরত উপদেশ দিতে থাকুন, কারণ নিশ্চয় উপদেশ মুমিনদের উপকারে আসে।” (৫১:৫৫)

গত আসরে আমরা বলেছি, যুগে যুগে কাফির ও মুশরিকরা নবী-রাসূলগণকে যাদুকর বলে আখ্যায়িত করেছে। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদর্শিত মুজিযা বা অলৌকিক ঘটনাকে মূল্যহীন করে তোলার এবং আল্লাহর সঙ্গে নবী-রাসূলগণের সম্পর্ককে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছে। এরপর এই দুই আয়াতে মহানবী (সা.)কে উদ্দেশ করে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, আপনি এ ধরনের মানুষদের হেদায়েত করার জন্য নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। কাজেই তারা হেদায়েত না পেলে আপনাকে ভর্ৎসনা করা হবে না।কাজেই আপনি তাদেরকে উপেক্ষা করুন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের দায়িত্বে ছেড়ে দিন। তাদের হেদায়েতপ্রাপ্ত হওয়ার আর কোনো আশা নেই কারণ, তারা সত্যকে উপলব্ধি করতে বা গ্রহণ করতে রাজি নয়।অবশ্য সাধারণ মানুষকে সতর্ক করা ও উপদেশ দেওয়া নবী-রাসূলগণের মূল দায়িত্ব। যে কেউ সত্য উপলব্ধি ও ঈমান গ্রহণ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে সে রাসূলে খোদা (সা.)-এর উপদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হেদায়েত পেয়ে যায় এবং সুপথপ্রাপ্ত হয়।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- সাধারণ মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া নবী-রাসূলদের দায়িত্ব হলেও এই কাজের ফলাফল তাঁদের ইচ্ছাধীন ছিল না। কেউ ঈমান না আনলে সে দায় নবী-রাসূলদের ওপর বর্তায় না।

২- সব মানুষ ঈমান গ্রহণ করবে- এই আশা যেন আমরা না করি। আমরা যেন তাদের কাছে বেশি বেশি দ্বীনের দাওয়াত দেই যাদের অন্তর কোমল ও সত্য গ্রহণে ইচ্ছুক।

৩- উপদেশ গ্রহণ করা ঈমানদার মানুষদের বৈশিষ্ট্য। কাজেই যে ব্যক্তি উপদেশ গ্রহণ করে না তার ঈমানের দাবিতে সন্দেহ থেকে যায়।

সূরা জারিয়াতের ৫৬ থেকে ৫৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالإنْسَ إِلا لِیَعْبُدُونِ ﴿٥٦﴾ مَا أُرِیدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِیدُ أَنْ یُطْعِمُونِ ﴿٥٧﴾ إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِینُ ﴿٥٨﴾

“আমি জ্বিন ও মানুষকে কেবল এ জন্য সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমারই ইবাদত করবে।”  (৫১: ৫৬)

“আর আমি তাদের কাছ থেকে কোন রিযিক চাই না এবং এটাও চাই না যে, তারা আমাকে খাওয়াবে।” (৫১: ৫৭)

“আল্লাহই তো সেই রিযিকদাতা, প্রবল শক্তিধর, পরাক্রমশালী।” (৫১: ৫৮)

এই তিন আয়াতের শুরুতে বলা হচ্ছে: মানুষকে কী উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে সার্বক্ষণিকভাবে যে বিষয়টি তাকে মনে রাখতে হবে। সৃষ্টির উদ্দেশ্য ভুলে গেলে তাকে গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট হয়ে যেতে হবে। এটা স্পষ্ট যে, মানুষকে সৃষ্টির একটি উদ্দেশ্য রয়েছে এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর কোনো প্রয়োজনে মানুষ সৃষ্টি করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল তাকে পূর্ণতায় পৌঁছে দেওয়া। এখানে মানুষকে তার পূর্ণতার পথ দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বলা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালার ইবাদত হচ্ছে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার একমাত্র পথ। এই ইবাদত আবার দুই প্রকার। এক প্রকার হচ্ছে নামাজ, রোজা ও হজ্বের মতো সরাসরি ইবাদত। আরেক প্রকার ইবাদত হচ্ছে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ যেসব কাজ করতে আদেশ করেছেন তা পালন করা এবং তিনি যেসব কাজে অসন্তুষ্ট হন তা পরিহার করা।

স্বাভাবিকভাবে মানুষ যদি সার্বক্ষণিকভাবে একথা ভাবে যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে দেখছেন তাহলে সে নিজের অবৈধ জৈবিক চাহিদা ও পার্থিব মূল্যহীন আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলোর ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে। আর সেক্ষেত্রে সে বিশ্বজগতের পরিপূর্ণ সত্ত্বা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারবে। একজন মানুষের পক্ষে পার্থিব জীবনে সর্বোচ্চ যে মর্যাদা অর্জন করা সম্ভব তা হচ্ছে এই আল্লাহর নৈকট্য।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- সৃষ্টির লক্ষ্য এবং তাতে পৌঁছানোর দিক দিয়ে জিন ও মানুষের মধ্যে মিল রয়েছে।

২- নিঃসন্দেহে মানুষের ইবাদতের প্রয়োজন আল্লাহর নেই, বরং আমরা মানুষেরা আল্লাহর ইবাদত করার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক পূর্ণতায় পৌঁছাতে পারি।

৩- রিজিক বা জীবিকা অর্জনের জন্য আমরা চেষ্টা করতে পারি কিন্তু তার ফল সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর ওপর নির্ভর করে। এক মুহূর্তের জন্যও আমাদেরকে ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের জীবিকার একমাত্র উৎস আল্লাহ তায়ালা।

সূরা জারিয়াতের ৫৯ থেকে ৬০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

 فَإِنَّ لِلَّذِینَ ظَلَمُوا ذَنُوبًا مِثْلَ ذَنُوبِ أَصْحَابِهِمْ فَلا یَسْتَعْجِلُونِ ﴿٥٩﴾ فَوَیْلٌ لِلَّذِینَ کَفَرُوا مِنْ یَوْمِهِمُ الَّذِی یُوعَدُونَ ﴿٦٠﴾  

"সুতরাং যারা যুলুম করেছে তাদের জন্য রয়েছে তাদের সম-মতাবলম্বীদের অনুরূপ প্রাপ্য [শাস্তি]। কাজেই তারা যেন এটার জন্য আমার কাছে তাড়াহুড়ো না করে [কারণ তারা তা পাবেই]।” (৫১: ৫৯)

“সুতরাং যারা কুফরী করেছে তাদের জন্য দুর্ভোগ সে দিনের, যেদিনের প্রতিশ্রুতি তাদের দেওয়া হয়েছে।” (৫১: ৬০)

সূরা জারিয়াতের শেষ এই দুই আয়াতে গোটা সূরার সারসংক্ষেপ বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এই সূরায় যেসব জাতির ঘটনাবলী সংক্ষেপে বলা হয়েছে দুঃখজনকভাবে তাদের সবাই নবী-রাসূলদের বিরোধিতা করেছে। তারা পার্থিব জীবনে আল্লাহর ক্রোধের শিকার হয়েছে এবং পরকালেও তাদেরকে শাস্তি পেতে হবে।

নবী-রাসূলদের বিরোধীরা সব সময় তাদের নবীদের কাছে কিয়ামত সংঘটনের দিন-ক্ষণ জিজ্ঞাসা করত। কিয়ামত কবে সংঘটিত হবে সে জ্ঞান নবীদের কাছে না থাকায় কাফিররা কিয়ামতের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসত। তাদের এ বক্তব্যের জবাবে আল্লাহ বলছেন, তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হবেই, কাজেই তোমরা কিয়ামতের জন্য তাড়াহুড়ে করো না। সেদিন হবে তোমাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর ও যন্ত্রণাদায়ক দিন। সেদিন তোমরা শাস্তি থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারবে না।  

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- মানুষ যদি তার জীবনের মূল লক্ষ্য অর্থাৎ পরকালীন জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে গাফিলতি করে এবং ওই লক্ষ্য অর্জনের কাজে সবোচ্চ চেষ্টা না চালায় তাহলে সে নিজের প্রতি অনেক বেশি জুলুম করে ফেলেছে।

২- মহান আল্লাহ তার প্রজ্ঞা অনুযায়ী মানুষকে ভালোবাসেন ও তার প্রতি ক্ষুব্ধ হন। কাজেই কোনো কিছু পাওয়ার জন্য আমরা তড়িঘড়ি করলেও তার জন্য নির্ধারিত দিনক্ষণ আসার আগে তা সংঘটিত হবে না।

৩- মানুষের ভাগ্য তার কর্মের ওপর নির্ভরশীল। কুফর ও জুলুম করলে দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহ তায়ালার ক্রোধের শিকার হতে হবে।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ